শিরোনাম
প্রতিবেদন : এনামুল হক এনা
পটুয়াখালী, ২৩ মার্চ, ২০২৫ (বাসস) : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রাজপথে নেমেছিল সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। দিনমজুর থেকে ব্যবসায়ী। ছাত্র থেকে চাকরিজীবী বাদ যায়নি কেউই। এরই অংশ হিসেবে গত ৫ আগস্ট রাজধানীর যাত্রাবাড়ী আন্দোলনে যোগ দেন মাছ ব্যবসায়ী মো. রাসেল (২৯)। যাত্রাবাড়ীর কাজলা ফুটওভার ব্রিজের নিচে পুলিশের গুলিতে নির্মমভাবে শহীদ হন তিনি।
শহিদ রাসেলের গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী জেলার দশমিনা উপজেলার আলীপুরা গ্রামে। তার বাবার নাম মরহুম আবু কালাম। আর মায়ের নাম সফুরা বেগম (৬০)। ছয় ভাইবোনের মধ্যে রাসেল ছিলেন তৃতীয়। ব্যক্তিগত জীবনে রাসেল বিবাহিত ছিলেন। তার স্ত্রীর নাম বর্ষা (২০)।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা(বাসস)কে ঘটনার বর্ণনায় শহীদ রাসেলের বড় ভাই মো. রুবেল বলেন, ৪ আগস্ট বিকেলে রাসেলের সাথে কথা বলেছি। তাকে বলেছি, আগামীকাল ৫ আগস্ট সকাল ৮টায় চলে আসবি। আমরা আন্দোলনে মেইন ঢাকার দিকে রওয়ানা দেব। পরের দিন সকাল ৮টার দিকে আমরা ছয় ভাই একসাথে জড়ো হই। পরে ছাত্র-জনতার সাথে যাত্রাবাড়ী থানা অতিক্রম করার পরিকল্পনা করি।
রুবেল বলেন, তখন সকাল সাড়ে ১০টা। আমরা ছাত্র-জনতার সাথে শনির আখড়া পার হয়ে কাজলা ফুটওভার ব্রিজের কাছে যাওয়ার সাথে সাথে পুলিশ, ছাত্রলীগ উপর্যুপরি গুলি করা শুরু করে।
তাকিয়ে দেখি চোখের সামনে চারজন লোক গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় শুয়ে পড়েছে। তারপর খেয়াল করলাম, গুলিবিদ্ধদের মধ্যে আমার ভাই রাসেলও আছে। গুলির এত বেশি তাণ্ডব ছিল যে আমার ভাইয়ের পড়া থাকা দেহটা তুলে আনতে পারিনি। আমরা রাসেলকে রাস্তায় শোয়া অবস্থায় রেখেই নিরুপায় হয়ে পিছু হটেছি। কারণ গোলাগুলির তীব্রতা ছিলো ভয়াবহ।
পরে আমরা নিরাপদ স্থানে এসে চিন্তা করেছি, কিভাবে গুলিবিদ্ধ আমার ভাই রাসেলকে ওই বিশ্বরোড থেকে নিরাপদ জায়গায় আনা যায়। আমরা গোলাগুলি থামার অপেক্ষায় ছিলাম। কোনোভাবেই থামছিল না। পুরো এলাকা জুড়ে থমথমে পরিবেশ। যখনই পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হতেই দৌড়ে গেলাম। আমার ভাইকে আর জীবিত পেলাম না।
রাসেল মূলত ঘটনাস্থলে মারা গেছে বলে জানান রাসেলের বড় ভাই রুবেল।
রুবেল জানান, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরেও শেষ চেষ্টা হিসেবে রাসেলকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে লাশ আনতে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়। ঢাকা মেডিক্যাল থেকে আমার ভাইয়ের লাশ দেবে না বলা হয়।
এরপরে আমি ছাত্র-জনতাকে জানালে তারা গিয়ে আমার ভাইয়ের লাশ আমাদের বুঝিয়ে দেয়। রাসেলের লাশ বাসায় এনে গোসল করিয়ে জানাজা দেয়া হয়েছে। রাসেল যেখানে গুলি খেয়ে শহিদ হয়েছে ঠিক সেখানেই তার জানাজা হয়েছে।
মৃত্যুপরবর্তী সব ধাপ শেষ করে রাসেলকে মাতুয়াইল কবরস্থানে দাফন করেছি। আমি চাই হুকুমের আসামি হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আর ডিবি হারুনের কঠিন বিচার হোক।
তিনি বলেন, সরকারের কাছে আমাদের চাওয়া এসব খুনিদের যেন ফাঁসি হয়। এছাড়া ছাত্রলীগ, যুবলীগও অনেককে গুলি করে মেরেছে তাদেরও বিচার চাই।
কান্নাজড়িত কন্ঠে রুবেল বলেন, ৪ আগস্ট কাজলা থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আমি দুইটি লাশ দিয়ে এসেছি। আর ওই জায়গাটাতেই আমার ভাই রাসেল মারা গেল।
এটি আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। আমি আমার ছোট ভাইকে অনেক মিস করি। রাসেলকে হারিয়ে আমার জগতটা অন্ধকার লাগে। কোথায় পাবো আমার কলিজার ছোট ভাইকে।
কোনো অর্থনৈতিক সহায়তা পেয়েছেন কি না জানতে চাইলে শহীদ রাসেলের বড় ভাই বাসসকে জানান, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী থেকে এ পর্যন্ত হাতে দুই লাখ টাকা পেয়েছি।
এরমধ্যে এক লাখ আমরা পেয়েছি, আরেক লাখ পেয়েছে তার বউ বর্ষা।
এছাড়া আমরা ‘জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনে’ আবেদন করেছি। তারা চেকও দিয়েছে ৫ লাখ টাকার। কিন্তু সেই টাকা কিছু জটিলতার কারণে হাতে পাইনি এখনও।
রাসেলের অসুস্থ মা সফুরা বেগম (৬০) কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, আমার ছেলেটাকে যারা মেরে ফেলেছে তাদের বিচার চাই। খুনিদের ফাঁসি চাই। আর আমার একটা ছেলেকে যেন সরকার চাকরি দেয়। আমার ছেলেটাকে সরকারি চাকরি দিলে আমি বাকি জীবন শান্তিতে পার করতে পারব। তাই সরকার যেন আমার একটা ছেলেকে চাকরির ব্যবস্থা করে দেন।
এটাই আমার সরকারের প্রতি চাওয়া।
শহীদ রাসেলের ভাবী রাত্রি আক্তার (২০) বলেন, রাসেল অত্যন্ত ভালো ছেলে ছিল। রাসেল যে মারা গেছে এখনো আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। ওর যত কথা সব আমার সাথে শেয়ার করতো। প্রতিদিন একবার হলেও আমার সাথে দেখা করত রাসেল। আমার ভাইয়ের জন্য অনেক খারাপ লাগে। এখন আমরা রাসেল হত্যার বিচার চাই। আর রাসেলের মায়ের দেখাশোনা করার জন্য একটা ছেলের সরকারি চাকরি চাই।
উল্লেখ্য, যাত্রাবাড়ী থানায় শেখ হাসিনাকে প্রধান করে ৩৬ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ২০০ জনকে আসামি করে শহীদ রাসেলের বড় ভাই মো.রুবেল একটি মামলা করেছেন।