বাসস
  ২৫ মার্চ ২০২৫, ০৯:৩৬

নাতিকে আইসক্রিম কিনে দিতে গিয়ে শহীদ হন মায়া ইসলাম

শহীদ মায়া ইসলাম - ছবি : বাসস

প্রতিবেদন: বরুণ কুমার দাশ

ঢাকা, ২৫ মার্চ, ২০২৫ (বাসস) : সেদিন ছিল ১৯ জুলাই। বেলা ৩ টার দিকে নাতি বাসিত খান মুসাকে নিয়ে আইসক্রিম কিনতে বাসার নিচে নামেন মায়া ইসলাম। বন্ধ থাকার কারণে নিচে নেমে মূল গেটের ভেতরে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। সেখানে তার সাথে ছিল নাতি মুসা খান। তারপর বাইরে থেকে আসা এক গুলি মুসার মাথায় লেগে তা বের হয়ে পেছনে থাকা দাদির তলপেটে ঢুকে যায়।

মাত্র সাত বছরে পা দিয়েছে বাসিত খান মুসা। মা নিশামনিকে বলেছিল, ‘মাম্মি, বাইরে গুলির শব্দ হচ্ছে।’ বাইরে গিয়ে গোলাগুলি দেখবে কি না জিজ্ঞেস করলে ওর মা ছেলেকে বাইরে যেতে ‘না’ করেন। পরে একসময় বাইরের পরিস্থিতি মোটামুটি শান্ত হয়ে এলে নাতি মুসাকে আইসক্রিম কিনে দিতে ছয় তলার বাসা থেকে নিচে নেমে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান দাদি মায়া ইসলাম আর নাতি মুসা খান হয় মারাত্মক আহত।

এ ঘটনা ঘটে ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই বেলা ৩টার দিকে রাজধানীর রামপুরা থানার সামনে মেরাদিয়া হাট এলাকায়। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সেদিন ওই এলাকায় পুলিশ ও ছাত্রলীগের সাথে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ চলছিল। পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছিল।এসময় একটি গুলিতে প্রাণ হারান মায়া ইসলাম। একই গুলিতে আহত মুসা খান এখন সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন।

রাজধানীর মালিবাগ বাজারে নিজ দোকানে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস-এর প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ মায়া ইসলামের স্বামী মাহবুব ইসলাম একথা জানান।

ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান জানান, তার বাসা রাজধানীর রামপুরা থানার সামনে মেরাদিয়া হাট এলাকায়। সাততলা বাড়ির ছয়তলার একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকেন তিনি। সেখানে তার স্ত্রী ও সন্তানের সঙ্গে তার বাবা ও মা মায়া ইসলামও থাকতেন। মালিবাগ বাজারে একটি ইলেকট্রনিক পণ্যের দোকান রয়েছে তার। তাদের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলায়।

মায়া ইসলামের মৃত্যুর ঘটনা

মাহবুব ইসলাম বলেন, বেশির ভাগ সময় মুসাকে ওর দাদিই আগলে রাখতেন। খাওয়ানো, গোসল করানো, স্কুলে নিয়ে যাওয়া, সব করতো ওর দাদি। সব আবদার ছিল তার দাদির কাছে। সেই দিনও দুপুর থেকেই নাতিটা আইক্রিম খাবে বলে বায়না ধরে। কিন্তু চার দিকে গোলাগুলি চলছিল, তাই কেউ নিচে নামেনি।

তিনি বলেন, ‘যখন মুসা তার দাদিকে সাথে নিয়ে বাসার নিচে নামে, তখন বাসার বাইরে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষ চলছিল। বাসার নিচের গেট বন্ধ থাকার কারণে তারা নিচে নেমে দাঁড়ায়। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ করে লুটিয়ে পড়েন শিশু মুসা খান ও তার দাদি মায়া ইসলাম।’

মাহবুব ইসলাম জানান, শিশু মুসার পেছনেই দাঁড়ানো ছিলেন মায়া। একটি গুলি এসে মুসার মাথার ওপরের অংশ ভেদ করে তার দাদির পেটে ঢুকে যায়। এতে দুজনেই গুরুতর আহত হন। পাশে থাকা মুসার বাবা মোস্তাফিজুর রহমান ছেলে মুসা খানকে নিয়ে ছোটেন পাশের হাসপাতালে।

মায়া ইসলামকে উদ্ধার করে প্রথমে বনশ্রী এলাকার একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরদিন ২০ জুলাই সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়ার পথেই মারা যান মায়া ইসলাম (৫২)।

মুসা খানের চিকিৎসা

গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরপরই ১৯ জুলাই মুসাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। দুই দিন পর পাঠানো হয় ওয়ার্ডে। এরপর অবস্থা খারাপ হলে বেলা আড়াইটার দিকে আবার আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়।

মুসা খিলগাঁও তালতলায় শহীদ বাবুল একাডেমি পল্লীমা সংসদে নার্সারিতে (ইংলিশ ভার্সন) পড়ে। তার বাবার নাম মুস্তাফিজুর রহমান। মেরাদিয়া হাট এলাকায় স্ত্রী, একমাত্র ছেলে ও মা-বাবাকে ভাড়া বাসায় থাকেন তিনি।

শহীদ মায়ার ছেলে ও নাতির অবস্থা

শহীদ মায়া ইসলামের স্বামী বলেন, স্ত্রীকে হারিয়ে ফেলেছি। আমার নাতিটার সিঙ্গপুরে চিকিৎসা চলছে। অবস্থা এখন আগের চেয়ে একটু ভালো। বাঁচলেও ভবিষ্যতে সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে কি না, জানি না। অন্তর্বর্তী সরকার আমার নাতিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ২০২৪ সালের ২২ অক্টোবর সিঙ্গপুর পাঠিয়েছে। সেখানেই ওর চিকিৎসা চলছে।

জানা গেছে, মায়া ইসলামের এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে মুস্তাফিজুর রহমান মায়ের মৃত্যুর সময় হাসপাতালে নিজের ছেলে মুসাকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি মৃত মায়ের মুখ দেখেন অ্যাম্বুলেন্সে। টাঙ্গাইলে তার জানাজা ও দাফনেও অংশ নিতে পারেননি তিনি।

মাহবুব ইসলাম বলেন, আমরা পরিবারের সদস্যরা মুসার ব্যাপারে আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। এক রকম মৃত ভেবে দাফন-কাফনের প্রস্তুতির কথাও বলছিল স্বজনদের কেউ কেউ। তবে সেই সময়েও হাল ছাড়েনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা।

মুসার অবস্থা ও ভবিষ্যৎ

শুরুতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, এরপর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ), এমনকি সর্বশেষ চেষ্টা হিসেবে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয় জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গুলিবিদ্ধ শিশু বাসিত খান মুসাকে। এখন তার অবস্থা অনেকটাই ভালো। তবে পুরোপুরি সুস্থ হতে আর সময় লাগবে।

তিনি বলেন, মুসা চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের সবচেয়ে ছোট যোদ্ধা। এক বুলেট তার দাদির শহীদ হয়েছে, আর মুসা হয়েছে আহত। এখনও তার বেঁচে থাকাটা হবে এক অলৌকিক ঘটনা।

বিচারের দাবি

অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রত্যাশার বিষয়ে জানতে চাইলে মাহবুব ইসলাম বলেন, আমি এই হত্যার বিচার চাই। আমার স্ত্রী শহীদ ও নাতি আহত হওয়ার পর আমাদের সংসারটা এলোমেলো হয়ে গেছে। আমার ছেলে ও বউমা নাতির কাছে। আমি এখন একা। আমরা ভালো নেই।

মায়া ইসলাম হত্যার ঘটনায় বাদী হয়ে ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান ১ নভেম্বর রাজধানীর খিলগাঁও থানায় মামলা করেন। মামলায় শেখ হাসিনাসহ ৮৭ জনকে আসামি করা হয়। মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়া সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকেও আসামি করা হয়েছে।