বাসস
  ২৬ মার্চ ২০২৫, ১০:০৮
আপডেট : ২৬ মার্চ ২০২৫, ১১:৩৩

পুত্র হত্যার বিচার চান শহীদ সুমন পাটোয়ারীর মা-বাবা

শহীদ সুমন পাটোয়ারী -ছবি : বাসস

প্রতিবেদন: রোস্তম আলী মন্ডল

দিনাজপুর, ২৬ মার্চ, ২০২৫ (বাসস) : দিনাজপুর চিরিরবন্দর উপজেলার পল্লী থেকে এক ভ্যান চালক বাবার পুত্র হাফেজ মো. সুমন পাটোয়ারী (২১) কষ্ট দূর করতে ঢাকায় গিয়েছিলেন গার্মেন্টসে চাকরি করতে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী হামলা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন তিনি।

শহীদ সুমন পাটোয়ারী (২২)-এর পিতা দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার লক্ষীপুর গ্রামের ওমর ফারুক (৫৪) কান্না জড়িত কণ্ঠে চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেন, ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজের পর, হঠাৎ করে তার মোবাইল ফোন বেজে উঠে। তিনি তার মোবাইল ফোন রিসিভ করলে অপর প্রান্ত থেকে তাকে জানানো হয়, ‘আপনার ছেলে সুমন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়ে সকালে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছেন।’

একথা শোনার পর হতভম্ব হয়ে মাথা ঘুরে পড়ে যান তিনি। এই অবস্থা দেখে মসজিদের মুসল্লিরা তাকে ধরে উঠিয়ে বসান এবং কী হয়েছে জানতে চান। তিনি মসজিদের মুসল্লিদের বলেন, তার ছেলে সুমন ঢাকায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে মারা গেছে।

এ সংবাদ পাওয়ার পর ওমর ফারুকের স্ত্রী শহীদ সুমনের মা মর্জিনা বেগম (৪২), তার কলেজপড়ুয়া মেয়ে ইসরাত জাহান উর্মি (১৮), ছোট ছেলে শিহাব সরকার (১৪) ও তার বৃদ্ধা মা ফাতেমা বেগম (৮২)সহ আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। শোকের ছায়া নেমে আসে পুরো এলাকায়।

ওমর ফারুক ৫ আগস্ট রাতে নিকটাত্মীয় চিরিরবন্দর উপজেলা শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের সভাপতি আব্দুল খালেকের সহায়তায় একটি মাইক্রোবাস নিয়ে ছেলের লাশ নিয়ে আসার জন্য ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। ৬ আগস্ট ভোরবেলা তারা ঢাকা পৌঁছেন। ঢাকার আশুলিয়া থানায় আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে সুমন পাটোয়ারীর লাশ গ্রহণ করেন।

সুমনের সহযোগী রুবেল ও সোহরাব জানায়, গত ৭ মাস ধরে শহীদ সুমনসহ ৮ জন একসাথে ঢাকা আশুলিয়া উপজেলার বাইপাইল এলাকার একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন।

তারা সকলেই গার্মেন্টসে কাজ করতেন। ৩ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কারণে গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে যায়। এরপর সুমনসহ তারা সকলেই ওই দিন থেকে ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেন।

ঘটনার দিন ৫ আগস্ট সকালে শহীদ সুমনসহ তারা গাজীপুর-ঢাকা মহাসড়কের বাইফেল নামক স্থানে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দেন। তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চলাকালে হঠাৎ করে রাস্তায় আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়। একই সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার ওপর গুলি বর্ষণ করতে থাকে।

এর মধ্যে আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্র-জনতার অনেকেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সুমনের সহযোগী আন্দোলনকারীরা আত্মরক্ষার চেষ্টায় এদিক-ওদিক দৌড়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে। পরে তারা সুমনকে তাদের সাথে দেখতে না পেয়ে তার খোঁজ করতে থাকে। এক পর্যায়ে ওই দিন সকাল সাড়ে ১০ টায় তারা রাস্তার ধারে সুমনের নিথর দেহ রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে দেখতে পায়।

সহপাঠীরা সুমনকে নিয়ে ঘটনাস্থলে কান্নাকাটি করতে থাকে এবং অনেকের কাছে সুমনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য সহযোগিতা চায়। কিন্তু আহত ও মৃত্যুর সংখ্যা খুব বেশি হওয়ায় কেউ কারো দিকে এগিয়ে আসতে পারছিলেন না। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা তখনও হামলা চালিয়ে যাচ্ছিল। ফলে ভয়ে কেউ ঘটনাস্থলে আসতেও সাহস পাচ্ছিল না।

দুপুরের পর পুলিশের ভ্যান এসে সুমনের মৃতদেহ ঘটনাস্থল থেকে আশুলিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক সুমনকে মৃত ঘোষণা করেন।

ওই দিন সন্ধ্যায় মাইক্রোবাসে লাশ নিয়ে লক্ষীপুর গ্রামে বাড়িতে পৌঁছেন ওমর ফারুক। ৬ আগস্ট রাতে এশার নামাজের পর সুমন পাটোয়ারীকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

সুমনের মা মর্জিনা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে সুমন সর্বশেষ এক মাস আগে ঢাকা গিয়েছিল। যাবার সময় মাকে বলে গিয়েছিল, বাবা অসুস্থ মানুষ, তিনি ডায়াবেটিস ও হাই-পেশারের রোগী। বাবা যেনো সন্ধ্যার মধ্যেই ভ্যান নিয়ে বাড়ি ফিরে। বেশি পরিশ্রম করলে বাবা আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে।’

তিনি আরও জানান, সুমন বলেছিল, ‘এরপর আমি ঢাকা থেকে এসে বাবাকে ভালো ডাক্তার দেখাব। যাতে বাবা চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিন্তু সুমন বাবার চিকিৎসা করানোর আগে নিজেই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেল।’ বলতে গিয়ে চিৎকার করে কাঁদছিলেন মর্জিনা বেগম।

সুমনের বৃদ্ধা দাদী ৮০ বছরের বয়সের ফাতেমা বেওয়া বলেন, ‘আমার অনেক বয়স হয়েছে, তার পরও কেনো আমি বেঁচে আছি? আমার নাতি এই অল্প বয়সে সকলকেই রেখে চলে গেল! এই দৃশ্য দেখার জন্য কি আল্লাহ আমাকে বাঁচে রেখেছে? আমার নাতি সুমনের আগে কেনো আমার মৃত্যু হলো না?’

সুমনের ছোট বোন উর্মি ও ছোট ভাই শিহাব বলেন, ‘বড় ভাই ঢাকা যাওয়ার সময় বলেছিল, এবার ঢাকা থেকে আসার সময় তাদের জন্য নতুন জামা কাপড় নিয়ে আসবেন।’ যারা তাকে গুলি করে মেরেছে, তারা তাদের বিচার দাবি করেন।

ওমর ফারুক বলেন, ‘আমি, আমার স্ত্রী মর্জিনা বেগম, বৃদ্ধা মা ফাতেমা বেওয়াসহ কেউ এখনও সুমনের শোক সামলে উঠতে পারি নাই। এখনও আমরা শোকে বিধ্বস্ত।

আমার ছেলে সুমন একটা আদর্শ ছেলে ছিল। সে সবার জন্য কিছু ভালো করতে চাইত। কিন্তু তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো।’

তিনি বলেন, ‘আমরা এই হত্যার বিচার চাই। যারা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত, তাদের বিচার হতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের ছেলে তার দেশ, সমাজের জন্য কাজ করতে চেয়েছিল, কিন্তু তার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। এখন আমাদের একটাই চাওয়া- বিচার।

আন্দোলনে সুমনের সাথী ও সহযোদ্ধা মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমরা এক সাহসী যুবক হারিয়েছি, যে ন্যায় ও সমতার পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। তার মৃত্যু শুধু এক পরিবারের নয়, এটি আমাদের সকলের ক্ষতি। সুমন যেন সারা দেশে পরিচিতি পায়। তার একাত্মতা ও অবদান আমাদের সবার মনে থাকবে।’