শিরোনাম
চট্টগ্রাম, ৮ এপ্রিল ২০২৫ (বাসস): ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের দিন পুলিশের গুলিতে নিহত চট্টগ্রামের অটোরিকশাচালক শহীদ জামাল উদ্দিনের পরিবার বর্তমানে চরম আর্থিক সংকটে দিন কাটাচ্ছে। পরিবারটির উপার্জনক্ষম একমাত্র সদস্যের মৃত্যুতে তাদের জীবনে অনিশ্চয়তা ও অসহায়ত নেমে এসেছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট হাটহাজারী উপজেলা সদরের বাসস্ট্যান্ডে স্বৈরাচার পতনের বিজয় উদযাপনকালে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন ৫৪ বছর বয়সী জামাল। সে দিনটি দেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ এক বাঁক হিসেবে বিবেচিত হলেও, জামালের মৃত্যুতে তার পরিবারে অন্ধকার নেমে এসেছে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ডের অক্সিজেন কুলগাঁও এলাকার বাসিন্দা জামাল স্ত্রী তাসলিমা বেগম, ছেলে তানিয়া আক্তার রুমী (১৯) ও ছেলে আল আমিন (১৭)কে নিয়ে হাটহাজারীতে বসবাস করতেন। হঠাৎ তাঁর মৃত্যুতে পরিবারটি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিজয় মিছিল ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ ও গুলি চালালে জামাল গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। আহত অবস্থায় তাঁকে প্রথমে হাটহাজারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এবং পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে রাত ৯টার দিকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তাসলিমা বেগম বলেন, ‘তারা নির্মম, নিষ্ঠুর, অমানবিক। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আমার স্বামী পানি চাইছিলেন, উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করছিলেন। তখনই তাঁর বুকে আরও একটি গুলি লাগে।’
তিনি অভিযোগ করেন, ‘পুলিশ থানার ছাদ থেকে নির্বিচারে গুলি ছুঁড়েছিল। এটা কোনো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার নমুনা হতে পারে না।’
স্বামীর মৃত্যুর পর পরের বাসাবাড়িতে কাজ করার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন তাসলিমা। স্থানীয় কিছু বাসাবাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করে কোনোমতে সংসার চালাচ্ছেন।
ছেলে আল আমিন একটি পেট্রোল পাম্পে মাসে সাত হাজার টাকা বেতনে কাজ করছে। মানসিকভাবে অসুস্থ মেয়ে তানিয়ার চিকিৎসাও অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে গেছে।
তাসলিমা জানান, কিছু দাতব্য সংস্থার আশ্বাসে হাটহাজারী সদরের পাশে একটি বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন, তবে এখন সে সহায়তা বন্ধ হয়ে গেছে। মাসিক তিন হাজার টাকার ভাড়া পরিশোধ করাও তাদের জন্য দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে।
সম্প্রতি সরকার শহীদ পরিবার হিসেবে তাঁদের ৫ লাখ টাকা এককালীন অনুদান দিয়েছে, যা দিয়ে তিনি মেয়ের চিকিৎসা ও নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচ মেটানোর চেষ্টা করছেন।
তাসলিমা জানান, ‘স্বামীর আয় খুব বেশি ছিল না, কিন্তু আমাদের জীবনটা সুখেই কেটেছে। ও ছেলে-মেয়ের কোনো চাহিদাই অপূর্ণ রাখেনি। এখন পেট চালাতে আমি প্রতিবেশীদের বাসায় ঝিয়ের কাজ করি। ছেলে আল আমিন স্থানীয় এক পেট্রোল পাম্পে মাসে ৭ হাজার টাকায় চাকরি করছে।’
তাসলিমা সহায়তার প্রতিশ্রুতি পেয়ে ছেলে-মেয়ে নিয়ে হাটহাজারী সদরের কাছে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে থাকার শুরু করেন। তবে যারা প্রথমে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তারা এখন আর ভাড়া দিচ্ছে না। মাসিক ৩ হাজার টাকা বাসা ভাড়া এখন তাসলিমার জন্য বাড়তি বোঝা।
তাসলিমা বলেন, ‘স্বামীর অনুপস্থিতিতে নিরাপত্তাহীনতায় অক্সিজেন এলাকার শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি।’
অর্থাভাবে মানসিকভাবে অসুস্থ মেয়ের চিকিৎসাও বন্ধ হয়ে গেছে উল্লেখ করে তাসলিমা বলেন, সামান্য আয়ে সংসার চলে না, মেয়ের চিকিৎসাও করা যাচ্ছে না।
তবে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রতিশ্রুত সহায়তা এখনো হাতে পাননি বলে জানান তিনি। তার অভিযোগ, কিছু মধ্যস্বত্বভোগী প্রতারণা করে তাদের সেই অর্থ থেকে বঞ্চিত করেছে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান শহীদ পরিবারের পাশে থাকার ঘোষণা দিলেও এখন পর্যন্ত রমজানে স্থানীয় বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার হেলালের দেওয়া কিছু খাদ্যসামগ্রী ছাড়া আর কোনো সহায়তা পাননি বলে জানান তাসলিমা। তবে ঈদের আগে ডেপুটি কমিশনার ফরিদা খানম তাঁদের নতুন কাপড় উপহার দিয়েছেন।
সরকারের কাছে আরও আর্থিক সহায়তা, মেয়ের চিকিৎসা ও বিয়ের খরচ, এবং ছেলে আল আমিনের জন্য একটি উপযুক্ত চাকরির আবেদন জানিয়েছেন তাসলিমা।
আবেগঘন কণ্ঠে কন্যা তানিয়া বলেন, ‘বাবা আমাকে খুব ভালোবাসতেন। কোনো চাওয়া কখনও উপেক্ষা করেননি। আমি ছাড়া তিনি রাতের খাবার খেতেন না।’
তাসলিমা ও তার মেয়ে জামালের হত্যার তদন্ত ও বিচার দাবি করে বলেন, ‘আমরা সব হারিয়েছি। এখন একটাই চাওয়া- এই হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার হোক।’
তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘এই দেশে কি কোনোদিন এমন শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ সমাজ গড়ে উঠবে না, যেখানে নির্দোষ মানুষ পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারাবে না?’