বাসস
  ১১ এপ্রিল ২০২৫, ১০:২৭
আপডেট : ১১ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৫৩

বড় আলেম হয়ে দেশ-জাতির সেবা করতে চেয়েছিলেন শহীদ শিফাতউল্লাহ

শহীদ শিফাতউল্লাহ, ছবি : বাসস

প্রতিবেদন: এস কে রাসেল

কিশোরগঞ্জ, ১১ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস) : বড় আলেম হয়ে দেশ ও জাতির সেবা করতে চেয়েছিলেন শিফাতউল্লাহ। কিন্তু দেশকে স্বৈরাচার ও ইসলামবিদ্বেষী শক্তি মুক্ত করতে গিয়ে ৫ আগস্ট গাজীপুর জেলার শ্রীপুর থানার মাওনার ২ নম্বর সিএন্ডবি আবদার মোড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে কিশোর বয়সেই শহীদ হন তিনি।

শ্রীপুরের মাওনার জামেয়া ইসলামিয়া এমদাদুল উলুম মাদ্রাসা ও এতিমখানার দশম শ্রেণির (শরহে বেকায়া) শিক্ষার্থী শিফাতউল্লাহ বাবার কাছে বলেছিলেন—মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে বড় আলেম হয়ে দেশ ও জাতির সেবা করবেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে দেয়নি স্বৈরাচার শেখ হাসিনা।

শিফাতউল্লাহ ছিলেন কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার জাঙ্গালিয়া ইউনিয়নের উত্তর চর কাওনাগ্রামের হাফেজ মাওলানা নুরুজ্জামান (৪৬) ও গৃহিণী মোছাম্মৎ কামরুন্নাহার (৪১) দম্পতির দ্বিতীয় সন্তান। শিফাতউল্লাহরা দুই ভাই ও দুই বোন—বড় ভাই হাফেজ মো. হিজবুল্লাহ (২১), ছোট বোন মোছাম্মৎ নাইমা (১৬) ও নাসিহাত (৫)।

কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার জাঙ্গালিয়া ইউনিয়নের উত্তর চর কাওনাগ্রামে গিয়ে দেখা যায়, শহীদ শিফাতউল্লাহর পরিবার বসবাস করে প্রত্যন্ত গ্রামে। মা-বাবা ছেলেকে আলেম বানাতে ভর্তি করেন গাজীপুর জেলার শ্রীপুরের মাওনার জামেয়া ইসলামিয়া এমদাদুল উলুম মাদ্রাসা ও এতিমখানায়। শহীদ হওয়ার সময় সেখানে দশম শ্রেণির (শরহে বেকায়া) শিক্ষার্থী ছিলেন শিফাতউল্লাহ।

শহীদ শিফাতউল্লাহর বাবা হাফেজ মাওলানা নুরুজ্জামান (৪৬) তালিমুল কুরআন হুসাইনিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক। তিনি জানান, 'শিফাতউল্লাহর কথায় আমি বাড়ির পাশে 'তালিমুল কুরআন হুসাইনিয়া মাদ্রাসা' নামে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছি। শিফাতউল্লাহ আমাকে বলেছিল—বাবা, আমি মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে বড় আলেম হব। আলেম হয়ে দেশ ও জাতির খেদমত করব। কিন্তু আমার শিফাতউল্লাহর স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে দিয়েছে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা।'

শিফাতউল্লাহ ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে গাজীপুর জেলার শ্রীপুর থানার মাওনার ২ নম্বর সিএন্ডবি আবদার মোড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে শহিদ হন। তার বুকের ডান পাশে একটি বুলেট লাগে এবং শরীর ভেদ করে বের হয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান তিনি।

পরে সন্ধ্যায় মাদ্রাসার শিক্ষক ফোন করে বিষয়টি তার পরিবারকে জানান। পরিবার গিয়ে মরদেহ বাড়িতে নিয়ে আসে। জানাজার নামাজ শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

শহীদ শিফাতউল্লাহর বাব ''আমার ছেলেকে যারা পাখির মতো গুলি করে হত্যা করেছে, আমি তাদের ফাঁসি দেখতে চাই' উল্লেখ করে বলেন, 'এপর্যন্ত সরকারিভাবে কোনো সহায়তা পাইনি। তবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা ও বিএনপির পক্ষ থেকে ১ লাখ টাকার অনুদান পেয়েছি।'

শহীদ শিফাতউল্লাহর বাবা হাফেজ মাওলানা নুরুজ্জামান শিফাতউল্লাহর স্মৃতিবিজড়িত মাদ্রাসাটি উন্নয়ন ও এর পাশে তার নামে একটি মসজিদ করে দিতে সরকারের সাহায্য প্রার্থনা করেন।

শহিদ শিফাতউল্লাহর বড় ভাই হাফেজ মো. হিজবুল্লাহ (২১) জানান, 'আমার ছোট ভাই অত্যন্ত নম্র-ভদ্র ছিল। গ্রামের কেউ বলতে পারবে না, তাদের সঙ্গে কখনও খারাপ ব্যবহার করেছে। মাদ্রাসা থেকে ছুটিতে বাড়িতে আসলে আমাদের মাদ্রাসায় বাচ্চাদের পড়ানোই ছিল তার একমাত্র কাজ।'

তিনি বলেন, 'বিশেষ করে মায়ের সঙ্গে তার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। মাকে নিজের হাতে মুখে তুলে ভাত খাওয়াত শিফাতউল্লাহ। আমাকে বলত—ভাইয়া, আমি বড় আলেম হয়ে আমাদের মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করব। সেখানেই পড়িয়ে গ্রামের শিশুদের আলেম বানাব। আমার ভাইকে যারা হত্যা করেছে, আমি তাদের বিচার চাই।'

চাচা মুফতি মোফাজ্জল হোসেন জানান, 'শিফাতউল্লাহ বাড়িতে আসলে পড়াশোনার কোনো বিষয় না বুঝলে আমার কাছ থেকে বুঝতে আসত, পরামর্শ নিত। তবে সে খুব লাজুক প্রকৃতির ছেলে ছিল। বেশি কথা বলতে লজ্জাবোধ করত। একা একা থাকতে বেশি পছন্দ করত। মাদ্রাসার ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তার বেশি সখ্য ছিল। এছাড়া সে মা-বাবার কাজে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাহায্য করত।'

তিনি আরও বলেন, 'শহিদ শিফাতউল্লাহর রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশ পেয়েছি। তার মতো আরও যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের সকলের হত্যাকারীদের বিচার হোক। এই বাংলাদেশের মাটিতেই যেন তাদের বিচার হয়—যাতে বাংলাদেশের জনগণ তা দেখে শিক্ষা নিতে পারে।'

মাদ্রাসা শিক্ষার্থী আল রাফি বলেন, 'শিফাতউল্লাহ ভাই যখন মাদ্রাসা থেকে বাড়িতে আসতেন, তখন আমাদের ভালো করে পড়াতেন। আমাদের সঙ্গে খেলাধুলা করতেন এবং মজাও করাতেন। এখন তিনি দুনিয়া থেকে চলে গেছেন, আমরা তার জন্য দোয়া করি—আপনারাও তার জন্য দোয়া করবেন।'