বাসস
  ১২ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:১৭
আপডেট : ১২ এপ্রিল ২০২৫, ২১:৫০

বৈষম্য ও ফ্যাসিবাদমুক্ত দেশ গড়ার প্রত্যয়ে জীবন দেন শহীদ মিলন

মোসলেম উদ্দিন মিলন - ছবি : সংগৃহীত

প্রতিবেদন : মো. মামুন ইসলাম

রংপুর, ১২ এপ্রিল (বাসস) : রংপুর শহরের পূর্ব গনেশপুরের এক সাধারণ মানুষ ছিলেন মোসলেম উদ্দিন মিলন। একটি বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র নির্মাণের স্বপ্ন দেখতেন তিনি। সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের সংগ্রামে শেষ পর্যন্ত জীবন দিয়ে শহীদ হয়েছেন তিনি।

রংপুর শহরের বেতপট্টিতে একটি স্বর্ণের দোকানে কাজ করতেন মিলন। অভাবের সংসার হলেও জীবনকে তিনি শুধু নিজের পরিবারের গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখেননি। দেশের প্রতি ছিল তার গভীর ভালোবাসা, ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সাহস। 

২০২৪ সালের জুলাই মাসের শুরু থেকে সারা দেশে মতে রংপুরে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের একজন লড়াকু যোদ্ধা ছিলেন মিলন। শিক্ষার্থীদের মতোই তিনিও বিশ্বাস করতেন- বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থায় বৈষম্য ও নিপীড়নের যে রূপ, তা মেনে নেওয়া যায় না।

দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে শুরু করে চাকরি, চিকিৎসা, প্রশাসন- সর্বত্রই যে বৈষম্য, সেটি একটি জাতির জন্য আত্মঘাতী। এই অবস্থায় চুপ করে বসে থাকা অপরাধ- এই বোধ থেকেই তিনি রাজপথে নামেন।

রংপুর শহরের একটি স্থানীয় গয়নার দোকানের কর্মচারী মুসলেম উদ্দিন মিলন (৩৬) জুলাই মাসের শুরু থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে নিয়মিত অংশ নিচ্ছিলেন।

তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, সমাজ থেকে সকল ধরনের বৈষম্য দূর না হলে এবং শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসন চলতে থাকলে, অনেকের মতোই তার দুই ছেলের ভবিষ্যৎও গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

এই আন্দোলনের একটি মিছিলে অংশগ্রহণের সময় ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের মেধাবী ছাত্র আবু সাঈদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পুলিশের গুলিতে বুক পেতে শহীদ হন। 

সেদিন মিলন পাশের এলাকায় প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করছিলেন। সেখানেই তিনি আবু সাঈদের শহীদ হওয়ার খবর জানতে পারেন।

এই খবরে মিলন খুব কষ্ট পান। কাছাকাছি এলাকায় থেকে এই খবর পেয়ে তিনি বিচলিত হয়ে পড়েন। সে রাতেই স্ত্রীকে বলেন- ‘সাঈদের রক্ত বৃথা যেতে দেওয়া যাবে না। সে শহীদ হয়েছে, আমি হলেও হবো। তবু ফ্যাসিবাদকে রুখতে হবে।’

তরুণ মিলন মহান আল্লাহর নামে শপথ করেন- তিনি ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারকে উৎখাত করবেন এবং প্রয়োজনে আবু সাঈদের রক্তের সম্মান রক্ষায় নিজের জীবন উৎসর্গ করবেন।

শহীদ মিলনের স্ত্রী দিলরুবা আখতার (২৬) বাসসকে বলেন, ঘটনাটা এমনই ছিল। আমাদের সব স্বপ্ন ভেঙে গেল, আমাদের দুই ছেলেকে এত তাড়াতাড়ি এতিম করে দিল। আবু সাঈদের শহীদ হওয়ার তিন দিন পর, ১৯ জুলাই মিলনও শহীদ হয়।’

রংপুর শহরের ২২ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব গণেশপুর এলাকার দরিদ্র এক পরিবারে জন্ম মিলনের। ধর্মভীরু ও উদ্যমী মিলন জীবিকা নির্বাহের জন্য এক গয়নার দোকানে ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করতেন।

তিনি ছিলেন সাত ভাইবোনের মধ্যে ষষ্ঠ। তারা দুই ভাই ও পাঁচ বোন। তার বাবা মখলেছুর রহমান ও মা মারজিনা বেগম কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। দুই বড় বোনও সাম্প্রতিক সময়ে মারা গেছেন।

তার একমাত্র বড় ভাই মিজানুর রহমান (৫০) নিজের পরিবার নিয়ে আলাদা বাসায় ভাড়া থাকেন। বাকি তিন বোন বিবাহিত, স্বামীর সঙ্গে সংসার করছেন।

স্বল্প আয়ের মানুষ হয়েও মিলন এলাকাবাসীর কাছে পরোপকারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বিপদে-আপদে সাহায্যে এগিয়ে আসতেন। ভ্রমণপ্রেমী ও সদা হাস্যোজ্জ্বল মিলন তার স্ত্রী দিলরুবা ও দুই ছেলে বায়েজিদ বোস্তামী (১৫) ও তানজিদ আল হাসান (৮)কে নিয়ে সুখেই সংসার করছিলেন।

বায়েজিদ রংপুর শহরের লায়ন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে এবং তানজিদ দারুস সালাম মাদ্রাসায় প্রথম শ্রেণিতে।

দিলরুবা বলেন, ‘আর্থিক অনটনের কারণে মিলন নবম শ্রেণির বেশি পড়াশোনা করতে পারেননি।  ২০০৯ সালে আমি যখন এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, তখন আমাদের প্রেম হয় এবং আমরা বিয়ে করি।’

বিয়ের পর দিলরুবা আর এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি। পরে তাদের দুটি ছেলে হয়।

দিলরুবা তার মা-বাবার তিন সন্তানের মধ্যে সবার ছোট। তার বাবা দুলাল সিকদার (৬০) লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলায় গার্মেন্টস ব্যবসায়ী। মা শিল্পী সিকদার গৃহিণী। দুই বড় ভাইও পাটগ্রামে গার্মেন্টস ব্যবসা করেন।

প্রায় আট বছর ধরে মিলন ‘বউরানী জুয়েলার্স’-এ ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছিলেন রংপুর শহরের বেতপট্টি এলাকায়।

দিলরুবা বলেন, ‘মিলন খুব হাসিখুশি ও ধার্মিক মানুষ ছিলেন। আমরা আমাদের যা ছিল, তা নিয়েই খুশি ছিলাম। তার স্বপ্ন ছিল আমাদের ছেলেদের ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। কিন্তু ফ্যাসিস্ট হাসিনা সেই স্বপ্নটাই কেড়ে নিল।’

প্রতিটি হিজরি মাসে মিলন তিনটি নফল রোজা রাখতেন। গত বছরের জুলাই মাসের ১৬, ১৭ ও ১৮ তারিখেও তিনি নফল রোজা রেখেছিলেন এবং প্রতিদিন মিছিলে অংশ নিচ্ছিলেন।

দিলরুবা বলেন, ‘মিলন শুধু প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নিতেন না, বরং ছাত্র ও জনগণের মিছিলের ওপর পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলার ভিডিও করতেন। রাতে বাড়ি ফিরে আমাকে সেই ভিডিও দেখাতেন।’

১৬ জুলাই রাতে মিলন তাকে আবু সাঈদের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ভিডিও দেখান- বুক পেতে গুলি খেয়ে পড়ে যাওয়ার দৃশ্য। 

তিনি বলেন, ‘সেদিন রাতে মিলন বলল, ‘আবু সাঈদ বীরের মতো জীবন দিয়েছে। আমরা এখন কী করব! আমি আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে না সরানো পর্যন্ত আমি থামব না।’

১৯ জুলাই শুক্রবার সকালে মিলন প্রতিবেশীদের উঠানে ডেকে বলেন, এখন আর ঘরে বসে থাকার সময় নেই। তিনি সবাইকে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদ পতনের আগ পর্যন্ত আন্দোলনে সামিল হওয়ার আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, শহীদ আবু সাঈদের মতো একজন দেশপ্রেমিকের জন্য জীবন উৎসর্গ করা গৌরবের বিষয়।

দিলরুবা বলেন, ‘সেদিন সকালে আমি নাশতা বানিয়েছি, কিন্তু মিলন কোথাও ছিল না। পরে দুপুরে সে বাড়ি ফিরে বলে যে ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে নাশতা করেছে। তারপর গোসল করে জুমার নামাজে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়।’

এ সময় তার বড় ছেলে বায়েজিদ বাড়ির নির্মাণ কাজ দ্রুত শেষ করার কথা বললে, মিলন জবাবে বলে, ‘বায়েজিদ, এটা আমি পারব না। তুমি বড় হয়ে শেষ করবে।’

জুমার নামাজ শেষে মিলন বাড়ি ফিরে আসে। দিলরুবা তখন মিলনের পছন্দের খাবার গরুর ভুড়ি ও খাসির মাংস রান্না করছিলেন।

তিনি বলেন, ‘আমি তখন বাথরুমে। সে বারবার বলছিল, ‘দিলরুবা, তাড়াতাড়ি খেতে দাও। আমাকে মিছিলে যেতে হবে।’ আমি ভেতর থেকে বললাম, একটু অপেক্ষা করো।’

‘কিছুক্ষণ পর বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখি, সে এত তাড়াহুড়ো করে খেয়েছে যে তার প্রিয় গরুর ভুড়িটাই খায়নি। আমি রাগ করলাম, এত কষ্ট করে রান্না করলাম, আর সে এত কম খেলো!’

দুপুর ২টার দিকে তার এক বন্ধু ফোন করলে মিলন দ্রুত বেরিয়ে গেছে বিক্ষোভে যোগ দিতে। এটাই ছিল দিলরুবার সামনে মিলনের শেষ উপস্থিতি।

সেদিন দিলরুবা ভীষণ ক্লান্ত ছিল। খেয়ে একটু ঘুমিয়ে পড়েন, যা সচরাচর তার কখনো হতো না। ঘুমের মধ্যেই মোবাইলে প্রায় ১০০টি মিসড কল আসে। ছোট ছেলে তানজিদ ছুটে এসে বলে: ‘মা, পুলিশ আব্বুকে গুলি করেছে।’

সেদিন বিকাল ৪টা ৩০ মিনিটে রাজা রামমোহন মার্কেটের পশ্চিম পাশে হাজারো ছাত্র ও জনগণের মিছিলে পুলিশের গুলিতে মিলন নিহত হন।

স্থানীয়দের সহায়তায় সহকর্মীরা মিলনকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। রাত সাড়ে ৯টায় তার মরদেহ বাড়িতে আনা হয়।

২০ জুলাই জোহরের নামাজের পর পূর্ব গণেশপুর এলাকার বায়তুল মা’মুর জামে মসজিদে মিলনের জানাজা হয়। পরে তাকে মুন্সিপাড়া কেন্দ্রীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়।

দিলরুবা, তার সন্তানরা, মিলনের ভাই-বোন, প্রতিবেশী ও স্বজনরা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে মিলনের খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।