শিরোনাম
প্রতিবেদন: সৈয়দ এলতেফাত হোসাইন
ঢাকা, ১৪ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস) : ‘আমার জন্য দোয়া করো’- এটাই ছিল ২৬ বছর বয়সী রড মিস্ত্রি মো. রিয়াজের শেষ কথা। ৫ আগস্ট ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ ব্যানারে আয়োজিত ঐতিহাসিক ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে যোগ দিতে যাওয়ার আগে তিনি তার ছোট মেয়েকে একথা বলেন।
এই আন্দোলনের মাধ্যমে প্রায় ১৬ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে। কিন্তু রিয়াজ আর কখনো বাড়ি ফিরে আসেননি, দেখে যেতে পারেননি তার লড়াইয়ের সফলতা। এই আন্দোলনের বিজয়ের কয়েক ঘণ্টা আগেই গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান তিনি।
৫ আগস্ট সকাল ১১টার দিকে ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকায় পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে এগোনোর সময় হাজারো মানুষের সঙ্গে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন রিয়াজ।
‘বাড়ি ছাড়ার আগে আমার স্বামী আমাদের ছোট মেয়ে, পাঁচ বছরের ফারিয়ার কাছে গিয়ে বলেছিল, ‘আব্বু মিছিলে যাচ্ছে। আমার জন্য দোয়া করো।’ বলেন রিয়াজের স্ত্রী ২৫ বছর বয়সী ফারজানা বেগম। স্মৃতিমেদুর গলায় সেই মুহূর্তগুলোর কথা তুলে ধরেন তিনি।
যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইল এলাকার সাদ্দাম মার্কেটে তার বাবার বাড়িতে তিনি এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন।
ফারজানা বলেন, ৪ আগস্ট মিছিল থেকে ফিরে রিয়াজ তাকে জানান, পরদিন সকালে তিনি ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে অংশ নেবেন।
‘আমি তাকে আটকানোর চেষ্টা করি। বলেছিলাম, আমাদের দুই মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভাবো।’ কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলেন তিনি। ‘কিন্তু সে বলেছিল, ‘চিন্তা করো না। আমার কিছু হবে না।’
ফারজানা স্মৃতিচারণ করে বলেন, রিয়াজ বলে যান, ‘যদি শহিদও হই, এনআইডি কার্ড সঙ্গে রাখব। যেন কেউ সহজে চিনে তোমার কাছে মরদেহ পৌঁছে দিতে পারে। আমাকে ক্ষমা করো।’
তিনি বলেন, ‘আমি জোর বাধা দিলে সে বলেছিল, সে মিছিলে যাচ্ছে না, বরং কাজে যাবে।’
৫ আগস্ট সকাল ৭টা ৪৭ মিনিটে ফারজানা ফোন করে রিয়াজকে কাজে যাওয়ার জন্য ডাকেন। কিন্তু রিয়াজ কাজে না গিয়ে এনআইডি, কোম্পানির আইডি এবং ফারজানার বাবা-মায়ের এনআইডির ফটোকপি নিয়ে ফোন রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন। যাওয়ার আগে ছোট মেয়ে ফারিয়াকে আবারও বলেন, ‘আমার জন্য দোয়া করো।’
ফারজানা জানান, সকাল ১০টার দিকে তিনি রিয়াজের কর্মস্থলে খোঁজ করতে লোক পাঠান, ভাবেন হয়তো সিদ্ধান্ত বদলেছেন। কিন্তু রিয়াজ সেখানে ছিলেন না।
বিকেলে যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং দেশত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়ে, তখনও তার মনে আশা জাগে, রিয়াজ ফিরে আসবেন। কিন্তু জানতেন না, তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর খবরটি অপেক্ষা করছে।
ফারজানা বলেন, ‘রায়েরবাগে গিয়ে ভেবেছিলাম, ওকে খুঁজে পাব। অনেকেই আনন্দ করছিলেন। কিন্তু ওকে পেলাম না।’ এরপরই এল ভয়ানক খবর।
আমার শাশুড়ি ফোন করে বলেন, যাত্রাবাড়ী থানার পাশে রিয়াজের নিথর দেহ পড়ে আছে। প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি। বলি, আপনি ভোলায় বসে জানলেন, আর আমি ঢাকায় থেকে কিছুই জানলাম না!’
ফারজানা জানান, শাশুড়ি বলেন, সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ছবিতে রিয়াজের মরদেহ দেখা গেছে, বুকের ওপর রাখা এনআইডি কার্ডসহ।
শোকাহত ফারজানা বলেন, ‘পরে আমার বাবা, ভাই ও ভাশুর যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে থেকে তাঁর মরদেহ উদ্ধার করেন। ৬ আগস্ট ভোলার দৌলতখান উপজেলার পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।’
রিয়াজ দুই কন্যা- ৮ বছর বয়সী বিবি ফাতেমা এবং ৫ বছর বয়সী ফারিয়াকে রেখে গেছেন।
তার মৃত্যুতে পরিবারে ভয়াবহ দুঃসময় এসে পড়েছে। তিনি ছিলেন শহর ও গ্রামে উভয় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।
ফারজানা বর্তমানে তার বাবা মো. ফারিদের সঙ্গে যাত্রাবাড়ীর সাদ্দাম মার্কেটে ছোট একটি ঘরে বসবাস করছেন। ফারিদ একজন সবজি বিক্রেতা, যিনি এখন তার মেয়ের পরিবারসহ আটজনের সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন।
ফারজানা বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। গ্রামের কুঁড়েঘরে এতজন একসঙ্গে থাকা সম্ভব না। তাই ঢাকায় থাকি। আমার স্বামী রড মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করে সংসার চালাতেন।’
অশ্রুসিক্ত চোখে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার আর কোনো উপায় নেই। যদি সরকার আমার দুই মেয়ের জন্য স্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা করত, খুব উপকার হতো।’
রিয়াজের গ্রামের পরিবারও তার ওপর নির্ভরশীল ছিল। তার বাবা আবদুর রহমান ১৫ বছর ধরে পক্ষাঘাতগ্রস্ত, বিছানায় শয্যাশায়ী। তার দুই ছোট ভাই, ১৬ বছরের আরিফ ও ১১ বছরের সাজিব এখনো নিজেরা উপার্জন করতে সমর্থ হয়নি।
ভোলায় বসবাসরত রিয়াজের মা, ৪৫ বছর বয়সী মোসাম্মৎ রানু মনি বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী পক্ষাঘাতগ্রস্ত। রিয়াজই সংসার চালাত। এখন আমাদের ভিক্ষা করে দিন কাটে।’
রিয়াজের শোকার্ত মা ফোনে বাসসকে বলেন, ‘লজ্জার হলেও বলতেই হচ্ছে- ছেলের মৃত্যুর পর থেকে স্বামীকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে আমি মানুষের বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করছি। আমাদের কিশোর দুই ছেলে এখনও কোনো উপার্জনের উপযুক্ত না।’
রিয়াজের স্ত্রী ফারজানা তার স্বামীর হত্যাকাণ্ড এবং আন্দোলনে নিহত অন্যান্যদের বিচার দাবি করেন।
ফারজানা বলেন, ‘আমার মেয়েরা এত ছোট বয়সে বাবাকে হারিয়েছে। কোনো টাকা কিংবা দান-উপহার তাদের বাবার জায়গা নিতে পারে না। আমি হত্যাকারীদের মৃত্যুদণ্ড চাই।’
তিনি বলেন, ‘স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা এই গণহত্যার জন্য মূলত দায়ী। আমি তাঁর মৃত্যুদণ্ড দাবি করি।’