শিরোনাম
প্রতিবেদন : এসকে রাসেল
কিশোরগঞ্জ, ১৪ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস) : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে চব্বিশের ১৯ জুলাই শুক্রবার বিকেলে মেয়ের জন্য চিপস আনতে গিশে রায়েরবাগের আপন বাজারে পুলিশ গুলিতে শহীদ হন কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের মো. মোবারক হোসেন (৩২)। মোবারকের আড়াই বছর বয়সী আদিবা এখনও তার বাবার চিপস নিয়ে ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকে।
কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ পৌরসভার পূর্ব নয়াকান্দি এলাকার মো. আবুল হাশেম দ্বিতীয় বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেলে মা জামেনা খাতুন ও ৭ মাস বয়সী ছোট ভাই মেশারফ হোসেনের দায়িত্ব এসে পড়ে ৭ বছর বয়সী মো. মোবারক হোসেনের ওপরে। সেই থেকে পরিবারের হাল ধরে ছিলেন মোবারক হোসেন। মৃত্যু আগ পর্যন্ত ছিলেন পরিবারের সবার প্রিয়পাত্র।
স্ত্রী-সন্তান ছোট ভাই ও মাকে নিয়ে রায়েরবাগের আপন বাজার এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন মোবারক হোসেন। ওইখানে ইলেকট্রনিক্সের একটি দোকানে কাজ করে পরিবার চালাতেন তিনি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ১৯ জুলাই শুক্রবার জুমার নামাজ পড়ে বাসায় এসে খাওয়া-দাওয়া করে আরাম করছিলেন মোবারক। এমন সময় আড়াই বছর বয়সী শিশু আদিবা বাবার কাছে বায়না ধরে চিপস খাওয়ার। শিশু আদিবার বায়না পূরণ করতে বাসার নিচের দোকান থেকে চিপস আনতে যান মোবারক।
বাসার নিচে নামার পরপরই পুলিশের গুলিতে লুটিয়ে পড়েন মোবারক। ছোট ভাই মোশারফ ও স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর অপারগতা প্রকাশ করেন ডাক্তাররা। তাই তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
শুক্রবারে বিকালে মৃত্যু হলেও পুলিশি বাধা এবং জটিলতায় মরদেহ কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের বাড়িত নিয়ে আসা হয় শনিবার রাতে। বাড়িতে জানাজা নামাজ শেষে রোববার দাফন করা হয় শহীদ মোবারককে। পুলিশের গুলিতে মারা গেলেও মোবারকের বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ।
শহিদ মোবারকের ছোট ভাই মোশারফ হোসেন বাসসকে জানান, 'আমার ভাই আমার পরিবারের অভিভাবক ছিলেন। পুলিশের গুলিতে আহত হলে তাকে উদ্ধার করে আমরা স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গেলেও সেখানে চিকিৎসা করানো যায়নি। সামান্য চিকিৎসা শেষে সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক আমার ভাইকে মৃত ঘোষণা করেন।'
তিনি বলেন, 'ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ভাইয়ের লাশ আনতে অনেক কষ্ট পোহাতে হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ বলে রায়েরবাগ থানার ক্লিয়ারেন্স ছাড়া লাশ দেওয়া যাবে না। ওখান থেকেও ক্লিয়ারেন্স পাচ্ছিলাম না। পরে শাহবাগ থানার ক্লিয়ারেন্সে শনিবার রাত ১১ টার দিকে বড় ভাইয়ের মরদেহ হস্তান্তর করা হয় আমাদের কাছে।'
তিনি আরও বলেন, 'শনিবার রাতে মরদেহ নিয়ে বাড়ি ফেরার পরে রোববার জানাজা শেষে বড় ভাইয়ের মরদেহ দাফন করা হয়। পরে রায়েরবাগ থানায় গিয়ে মামলা করতে চাইলেও দেখি পুলিশ উল্টো মামলা দিয়ে রেখেছে আমার ভাইয়ের নামে। কী আশ্চর্যের বিষয়! পুলিশের গুলিতে আমার বড় ভাই মোবারক নিহত হলেও সেই পুলিশই আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে রেখেছে!'
তিনি অবিযোগ করেন, 'আমার ভাইয়ের মুখে দাড়ি ছিল তাই পুলিশ দাবি করে আমার ভাই জামায়াত-শিবিরের লোক। আমরা বেশি চাপাচাপি করলে আমাদেরও বিপদ হবে। পরে মামলা না করেই ফিরে আসি আমরা। এখন দেশ নতুনভাবে স্বাধীন হয়েছে। তাই এই সরকারের কাছে আমার ভাইয়ের হত্যার বিচার চাই। সেই সাথে আমার ভাইয়ের একটি ছোট্ট মেয়ে রয়েছে সরকার যেন তার ভবিষ্যৎ দেখে। সরকারের সহায়তা পেলে আমরা ভাই হত্যার বিচার চেয়ে মামলা করতে চাই।'
শহীদ মোবারকের মা জামেনা খাতুন (৫০) এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, 'যারা আমার বড় ছেলে মোবারককে হত্যা করেছে নিজ চোখে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেখে যেতে চাই।'
চাচতো বোন হাওয়া বলেন, আমি চাচতো বোন হলেও মোবারকের ব্যবহার এমন ছিল যে কোনোদিন বুঝতে পারিনি সে আমার চাচতো ভাই। শুধু আমি কেনো, পাড়া-প্রতিবেশীসহ ১০ জন মানুষ বলবে মোবারক অনেক ভালো ছেলে ছিল। তার পরিবারের দায়িত্ব যাতে সরকার নেয়। আমরা মোবারকের হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই।'
শহিদ মোবারকের স্ত্রী শান্ত (শিউলী বেগম) (১৯) বলেন, 'আমাদের আরেকটি মেয়ে ছিল সেই মেয়েটি আড়াই বছর আগে মারা যায়। পরে আদিবার জন্ম হয়। তাই বাবার খুব আদরের ছিল ও। শুক্রবার নামজ শেষ বাসায় এসে খাবার খেয়ে বিছানায় আরাম করছিলেন আমার স্বামী। এমন সময় আমাদের একমাত্র মেয়ে আদিবা চিপস খেতে বায়না ধরে।
আদিবার বাবা তাকে অনেক বেশি ভালবাসত। মেয়ে যা চাইত তাই কিনে দিত। আদিবা চিপস খাওয়ার বায়না ধরতেই বাসার নিচের দোকান থেকে চিপস আনতে যান তিনি। চিপস আনতে গিয়ে দোকানের সামনেই পুলিশের গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি।'
শিউলি বেগম বলেন, 'আমার ছোট একটা বাচ্চা নিয়ে আমি এখন খুবই বিপদে পড়ে গেছি। সেই সাথে আমার শাশুড়ি ও পরিবারের লোকজনও অসহায় হয়ে গেছে। বর্তমান সরকারের কাছে আমি আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই ও আমার পরিবারের দায়িত্ব যাতে সরকার নেয় এই দাবি জানাই।'
করিমগঞ্জ উপজেলা বিএনপির প্রচার সম্পাদক হাবিবুর রহমান বিপ্লব বাসসকে বলেন, ২৪ আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছে তাদের পরিবারের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা রয়েছে। তাদের যেকোনো সমস্যায় আমরা তাদের পাশে দাঁড়াবো। ইতোমধ্যে আমার দল বিএনপি শহীদ মোবারকের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। এছাড়াও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকেও আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়েছে।