শিরোনাম
প্রতিবেদন : সৈয়দ এলতেফাত হোসাইন
ঢাকা, ২০ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস) : মো. জাহাঙ্গীর আলম চব্বিশের ১৯ জুলাই ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে শহীদ হয়েছেন। শাহাদতের বেশ কয়েক মাস পেরিয়ে গেলেও তার স্মৃতি আজও তাকে তাড়া করে ফেরে তার ১৪ বছর বয়সী মেয়ে সিনথিয়াকে।
প্রতিটি সকালে বাবার অনুপস্থিতির নিস্তব্ধতা যেন তাকে স্তব্ধ করে দেয়। বাবার আদর-ভালোবাসার স্মৃতিই এখন তার একমাত্র সম্বল। জাহাঙ্গীর সেদিন ঘর থেকে বেরিয়েছিলে, কাজের উদ্দেশ্যে, কিন্তু আর ফিরে আসেননি। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নির্মমভাবে প্রাণ হারান তিনি।
৪৮ বছর বয়সী জাহাঙ্গীর ছিলেন একজন শাক বিক্রেতা। গণআন্দোলন দমন করতে গড়ে ওঠা কঠোর অভিযানের শিকার হন তিনি—যে আন্দোলনের মাধ্যমে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট প্রায় ১৬ বছরের ফ্যাসিস্ট শাসনের পতন ঘটে।
২০২৪ সালের ১৯ জুলাই কাজলার ব্রিজে শাক আনতে গেলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন জাহাঙ্গীর। তার বুকে গুলি লাগে এবং তা ভেতরে ঢুকে আটকে যায়। তাদের বাসা থেকে মাত্র ২০০-৩০০ মিটার দূরে ঘটে এই মর্মান্তিক ঘটনা। পরিবারটি পুরোপুরি ভেঙে পড়ে।
জাহাঙ্গীরের ছোট মেয়ে সিনথিয়া নবম শ্রেণির ছাত্রী।পড়ে কাজলারপাড় উচ্চ বিদ্যালয়ে। বাবার মৃত্যু মেনে নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এই প্রতিবেদক যখন তার বাবা জাহাঙ্গীরের কথা জানতে চায়, তখন কান্নায় ভেঙে পড়ে সে।
সে বলে, ‘আমি এক মুহূর্তের জন্যও বাবাকে ভুলতে পারি না। অন্যদের বাবাকে 'বাবা' বলে ডাকতে দেখে বুকটা হাহাকার করে ওঠে। যদি আরেকবার 'বাবা' বলে ডাকতে পারতাম!’
‘প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার সময় বাবাকে খুব মনে পড়ে। তিনি আমাকে টিফিনের টাকা দিতেন, হাসিমুখে বিদায় জানাতেন। এখন কেউ আর টিফিনের টাকা দেয় না, কেউ দরজায় দাঁড়িয়ে বিদায়ও জানায় না,’ কান্নাভেজা গলায় বলে সিনথিয়া।
জাহাঙ্গীরের দুই মেয়ের মধ্যে সে ছোট। বড় বোন মিথিলা বিবাহিত, মা তাসলিমা বেগম অসুস্থ। এই অবস্থায় সিনথিয়ার ভবিষ্যৎ খুব অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
সিনথিয়া বলে, ‘আমি পড়ালেখা করতে চাই। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে মায়ের পাশে দাঁড়াতে চাই।’ কিন্তু তাসলিমা এখন আর কোনো কাজ করতে পারেন না। মেয়ের পড়ালেখার খরচ চালানোও তার পক্ষে অনেকটা অসম্ভব।
সিনথিয়া বলে, ‘যিনি আমার পড়াশোনার খরচ দিতেন, তিনি এখন আর আমাদের মধ্যে নেই। আমি কীভাবে পড়ালেখা চালিয়ে যাব? আমার পড়াশোনার দায়িত্ব কে নেবে?’
পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন জাহাঙ্গীর। তার মৃত্যুতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে পুরো পরিবার। ৩৯ বছর বয়সী তসলিমা বলেন, ‘আমার স্বামী একজন সৎ আর পরিশ্রমী মানুষ ছিলেন। পরিবারের জন্য সামর্থের সবটুকু ঢেলে দিতেন।’
তসলিমা জানান, ‘বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে কাজলার ব্রিজ থেকে শাক আনতে গিয়ে পুলিশ তার স্বামীকে গুলি করে হত্যা করে। খবর পেয়ে তার দেবরেরা ঘটনাস্থলে গিয়ে তাকে মুগদা হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’
ওই রাতেই জাহাঙ্গীরের মরদেহ বাড়িতে আনা হয় এবং রাতেই কাজলারপাড় কবরস্থানে দাফন করা হয়।
ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন যখন ভয়াবহ রূপ নেয়, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তখন নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে। সে সময় বহু লাশ গায়েব করে ফেলার অভিযোগও রয়েছে।
তসলিমা বলেন, ‘আমার স্বামী শাক বিক্রি করে সংসার চালাতেন। এখন আমরা অসহায়, দিশেহারা। আমার কোনো ছেলে নেই—আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি অনিশ্চয়তায় পড়ে গেলাম।’
স্বামীর মৃত্যুর পর তার স্বাস্থ্যেরও অবনতি হয়েছে। এখন কোনো কাজ করতে পারেন না। তিনি বলেন, ‘আমি জানি না কীভাবে এখনও টিকে আছি। এখন আমার ছোট মেয়ে সিনথিয়াকে নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তা হয়। কীভাবে ওর জন্য একটা ভালো ভবিষ্যৎ গড়ব, বুঝতে পারি না।’
সরকারের সহায়তা কামনা করে তসলিমা বলেন, ‘সরকার যদি সহায়তা করে, তাহলে আমার মেয়ে অন্তত পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারবে।’
সিনথিয়া বলে, ‘সরকারের উচিত জুলাইয়ের শহীদ পরিবারের পাশে দাঁড়ানো।’
তার আরও দাবি, ‘আমার বাবা একজন ভালো মানুষ ছিলেন। কিন্তু পুলিশ তাকে মেরে আমাদের এতিম করে দিয়েছে। আমি চাই, যারা আমার বাবাকে মেরেছে, তাদের ফাঁসি হোক।’