বাসস
  ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ১১:৪৩
আপডেট : ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ১২:১০

আমারে শহীদের মা বানাইয়া পোলায় কবরে ঘুমায় রইছে : শহীদ সজলের মা

শহীদ সজল, ছবি : বাসস

প্রতিবেদন : নুসরাত সুপ্তি

নারায়ণগঞ্জ, ২৩ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস) : দিনটি ছিল ১৯ জুলাই, ২০২৪। সকালে সূর্য উঠেছিল আগের মতোই। বাতাসে ছিল গ্রীষ্মের তেজাল গন্ধ। কিন্তু সেই দিনের সকাল ছিল আলাদা। সারা দেশের মতো নারায়ণগঞ্জের চিটাগাং রোডেও পালিত হচ্ছিল ‘কমপ্লিট শাটডাউন’।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে মানুষ রাস্তায় নেমেছিল। কারও হাতে পোস্টার-ফেস্টুন, মাথায় সবুজ-ঘেরা রক্তিম সূর্যের জাতীয় পতাকার ব্যান্ড, কারও কণ্ঠে উচ্চকিত স্লোগান—তাদের দাবি ছিল, সকল বৈষম্যে অবসানের, ন্যায্য ও সমান অধিকারের, সমান মর্যাদার। কিন্তু রাষ্ট্র তাদের সেই কণ্ঠরোধ করতে বেছে নেয় নিষ্ঠুর দমন-পীড়নের পথ।

সেদিন সকাল থেকেই নারায়ণগঞ্জের চিটাগাং রোড এলাকায় আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে চলছিল গুলির বিকট শব্দ। হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ, ককটেল বিস্ফোরণ আর একের পর এক ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া— পুরো এলাকা পরিণত হয় এক ভয়ানক রণক্ষেত্রে

এক টুকরো স্বপ্নের মৃত্যু

সেই দিন, সেই রাস্তায়, একটুকরো স্বপ্ন মরে গিয়েছিল। নাম তার সজল। বয়স মাত্র ২৩। জীবনের পুরোটা সময় পরিবার আর সমাজের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া এক তরুণ, যিনি নিজের সব কষ্ট ঢেকে রাখতেন অনাবিল হাসির মোহন প্রলেপে।

সেই সময় প্রাণ বাঁচাতে একটি চায়ের দোকানে আশ্রয় নিয়েছিলেন সজল। কিন্ত লুকিয়েও শেষরক্ষা হয়নি। পুলিশের গুলিতে নিহত হন সিদ্ধিরগঞ্জের মৌচাক এলাকার বাসিন্দা সজল।

আশার আলো ছিল সজল

সজল ছিল চার ভাইবোনের মধ্যে বড়। সজলের মা-বাবা কখনোই ঠিকমতো পেটপুরে খেতে পারেননি। কিন্তু ছেলেমেয়েদের মুখে যেন কখনও অভাবের ছায়া না পড়ে—এই ছিল তাদের ব্রত। এই শিক্ষাটি মনে-প্রাণে মানতেন সজলও।

ভাইবোন পড়ালেখা করলেও নিজে বাবার সাথে সংসারের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন সজল। চিটাগাং রোডে বাবার সাথে জুতার কারখানায় কাজ করতেন।

আব্দুল হামিদ ও রুনা বেগমের চার সন্তানের মধ্যে বড় ছিল সজল। ছোটবেলা থেকেই শান্ত স্বভাবের। সজলের বোন রাইফা (১৭), ছোট বোন রুবিনা (১৪) ও  ইব্রাহিম (১১) মাদরাসায় পড়ালেখা করছে।

'তোমার লগেই ঘুমামু, মা... আসতাছি'

সজলের মা রুনা বলেন, 'আমি জানতাম  সজল লুকায় লুকায় আন্দোলনে যায়, সামনে রাগ দেখাইলেও যাইতে বাধা দেই নাই৷ কিন্তু ওইদিন মনটা কেমন কেমন জানি করতাছিল। গুলির আওয়াজ ঘরেও পাইতেছিলাম৷'

আগের রাতে সজলের মা রুনা বেগম ঘুমাতে পারেননি। বুকের ভেতরটা কেমন জানি অস্থির লাগছিল। বারবার ছেলেকে বলছিলেন, 'তুই যাস না রে বাবা, রাস্তায় কিছু হইব। তোর মুখের দিকে তাকাইলেই ডর লাগে।'

রুনা বেগম বলেন, 'দুপুরে খাওয়ার পর আমি সজলরে বলছিলাম , তুই বাহিরে যাইছ না, আমারে পাশে শুইয়া ঘুমা। 'মা তোমার লগেই ঘুমামু, একটু আসতাছি' বলে আন্দোলনে চলে গিয়েছিল সজল। এই শেষ কথা হয় আমার ছেলের সাথে।'

মরলে তুমি শহীদের মা হবা

শহীদ সজলের মা রুনা বেগম তার আদরের বড় সন্তানকে হারিয়ে এখনও গভীর শোকে ডুবে আছেন। যা তাকে মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত করে তুলেছে।

মা আন্দোলনে যেতে নিষেধ করলে সজল বলত, 'সবাইকেই দেশের জন্য রাস্তায় নামতে হইবো মা, ঘরে থাইকাও কেউ নিরাপদ নাহ্। আমি মরে গেলে তুমি শহীদের মা হবা। মনে করবা আমার আয়ু ওইটুকুই ছিল।'

রুনা বেগম ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, 'আমারে শহীদের মা বানাইয়া পোলায় কবরে ঘুমায় রইছে। আর আমার পাশে শুইয়া ঘুমাইতে আইবো না। কইবো না, মা তোমার লগেই ঘুমামু!'

রাস্তায় রক্ত আর রক্ত

আব্দুল হামিদ ছেলের মৃত্যুর দিনের লোমহর্ষক স্মৃতি মনে করে বলেন, 'আমি মাদানীনগর মাদরাসার সামনে ছিলাম। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দেখি, কেউ মারা গেছেন, কারও হাত নেই, কারও পা নেই। রাস্তায় রক্ত আর রক্ত।'

'এ সময় রাস্তার উপর পড়ে থাকা এক ছেলেকে উদ্ধার করতে গেলে পুলিশ সমানে গুলি করতে থাকে।পরে লাশডা কোনরকমে এলাকার গলির ভিতরে আইনা রাখি।'

মনডা ঢুক কইরা ওঠে

তিনি বলেন, 'এরমধ্যে কয়টা বাজে দেখতে ফোন নিয়া দেখি, অপরিচিত নাম্বার থেকে ৫৫ টা মিসডকল। সাথে সাথে কল দিলে ওইপাশ থেকে একজন বলে আমার একজনরে সুগন্ধা হাসপাতালে আনছে। ভয়ে মনডা ঢুক কইরা ওঠে। আমি জানি বাহিরে আমার পোলায় আর ভাই মামুন আছিল।'

আব্দুল হামিাদ বলেন, 'অলিগলি দিয়ে ঘুরে হাসপাতালে যাই। গিয়া দেখি মুখের উপর কাপড় দিয়া রাখছে। কাপড় সরায় দেখি আমার পোলার লাশ। মাথা ঘুরায় ওনেই মাটিতে লুটায় পড়ি।'

তারপর বললেন, 'পরে রাতে পোলার লাশ বাড়িত নিয়া যাই। ছেলেরা যে এলাকায় মারছে, ও'নে কবর দিতে মনডা মানে নাই। আমার বাড়ি আড়াইহাজারের শালমদী, শালমদী কবরস্থানে ওরে কবর দিছি।'

'হাসিনারে নামাইতে পোলা হারাইছি'

সজলের বাবা বলেন, আওয়ামীলীগের বিক্ষোভে পড়ে কয়েক বছর আগে আমার অনেক টাকার ক্ষতি হয়। সেইডা নিয়া আমার কোনো খেদ নাই।
আমার ছেলে বা আমরা তো কেউ কোটায় চাকরি করতাম না। আমাগো সেই চাহিদা ছিল না।'

'কিন্তু হাসিনার মতোন খারাপ মানুষকে সরকার থেকে নামাইতে চাইছিলাম। হাসিনাকে নামাইতে গিয়া সন্তান হারাইছি। ছেলেরে বিসর্জন দিয়া এই দেশের স্বাধীনতা পাইছি।'

'ঈদে কিচ্ছু খাইতে পারি নাই'

সজলের মুখে ‘মা’ ডাকই ছিল রুনা বেগমের জীবনের প্রথম আশীর্বাদ। মা রুনা বেগম কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, 'সজল আমারে মা বানাইছে, ওর মুখে প্রথম মা ডাক শুনছি। ওরে ছাড়া আমি কেমনে দিন পার করি সেটা আমিই জানি।'

মা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, 'আমার সজল ঈদে বিরানি পছন্দ করত। ছোট ছেলের কথায় বিরানি রানছিলাম, কিন্তু আমার সজল তো নাই। বিরানি মুখে তুলতে পারি নাই।' একথা বলেই ছেলের শোকে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন ছেলে হারা মা।

ক্ষতিপূরণ, সহানুভূতি ও বিচার

সজলের পরিবার জামায়াতে ইসলামী থেকে ২ লাখ, জেলা প্রশাসন থেকে ২ লাখ এবং জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকা পেয়েছে। কিন্তু মা রুনা বেগম বলেন, 'এই কাগজের টাকার কী দাম, বলো! টাকা দিয়া কি আমার পোলা ফিরা পামু?

প্রতিদিন ভোরবেলা দরজার দিকে তাকিয়ে থাকেন রুনা বেগম। এখনও যেন মনে হয়, সজল দরজার গলি পেরিয়ে এসে বলবে, 'মা, খাইবা? চল, বাজার থেইকা কিছু আনমু।' কিন্তু না, শুধু নিস্তব্ধতা, আর বুকের গভীরে চাপা কান্নাই ফিরে আসে বারবার।

শেষ কথায় শুধু এটুকুই বললেন—

ছেলের হত্যার বিচার চেয়ে ক্ষুব্ধ এই মা বলেন, 'আমার ছেলেরে যারা মারছে তাগো আমি বিচার চাই, আমি বাঁইচা থাকতে ওই জালেমগো বিচার দেখতে চাই।'