শিরোনাম
প্রতিবেদন : মো. মামুন ইসলাম
রংপুর, ২৮ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস) : রংপুরের রাধাকৃষ্ণপুর মৌলভীপাড়ার এক প্রিয় মুখ মো. ছমেছ উদ্দিন। গ্রামের সকলের কাছে পরিচিত ছিলেন সদা হাস্যোজ্জ্বল ও নিরহংকার এক সহজ-সরল ভালো মানুষ হিসেবে। কিন্তু ফ্যাসিবাদী শাসনের নির্মমতা, গুম, খুন, দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন আর লুটপাট নিয়ে ছিল তার গভীর উদ্বেগ।
ধর্মভীরু অথচ রাজনীতি সচেতন এই স্বল্পশিক্ষিত এই গ্রামীণ কৃষক স্বপ্ন দেখতেন—এ দেশ একদিন মুক্ত হবে অন্যায়, বৈষম্য ও শোষণের শৃঙ্খল থেকে। বিশ্বাস করতেন, একদিন আল্লাহর পরিকল্পনায় সাধারণ মানুষের মুক্তি আসবেই। বিশ্বাস করতেন, সব অন্যায়-অবিচারের শেষ আছে।
সেই বিশ্বাসই তাকে নিয়ে যায় ফ্যাসিবাদের চোখে ভয়ংকর হয়ে ওঠা জনগণের মুক্তির আন্দোলনের পাশে। মানুষের মুক্তি অনিবার্য—এ বিশ্বাস বুকে নিয়ে জুলাই বিপ্লবের শুরু থেকেই শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হন ছমেছ উদ্দিন।
ন্যায়ের পক্ষে মাথা উঁচু করে সোচ্চার হন প্রতিবাদে-বিক্ষোভে, মিছিলে-মিটিংয়ে। ফলে যা হবার তা-ই হয়, নিপীড়ক রাষ্ট্রযন্ত্রের চক্ষুশূল হয়ে ওঠেন তিনি।
কড়া নজরদারিতে পড়েন স্বৈরাচারের সহযোগী হয়ে ওঠা পুলিশ বাহিনীর , হয়ে উঠেন নিষ্ঠুর দমন-পীড়নের এক নিখুঁত নিশানা।
এর পরিণতি হিসেবে ২০২৪ সালের ২ আগস্ট সন্ধ্যায় গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারের পতনের প্রাক্কালে পুলিশের একটি দল তাকে গ্রেপ্তার করতে হায়েনার মতো তাড়া করে। রুদ্ধশ্বাসে পালাতে গিয়ে পথে পড়ে যান ৬৫ বছরের প্রবীণ ছমেছ উদ্দিন; দম আটকে প্রাণ হারান। যেন জীবন দিয়ে এদেশের মানুষের কাঙ্ক্ষিত মুক্তির অনিবার্য দিনটিকে ত্বরান্বিত করে গেলেন তিনি।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)-এর সঙ্গে আলাপকালে আমেনা বেগম, ছেলে আশিকুর, পুত্রবধূ শারমিন আক্তার ও স্থানীয় মানুষজন সেদিনের কথা বলতে গিয়ে আবেগ ধরে রাখতে পারেননি।
শহীদ ছমেছ উদ্দিনের স্ত্রী মোসাম্মৎ আমেনা বেগম (৫৫) একজন গৃহিণী ও স্থানীয়ভাবে সম্মানিত ধর্মপরায়ণ নারী। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে।
ছেলে মো. আশিকুর রহমান (২৫), ২০১৮ সালে রংপুরের ইমেজ ইনস্টিটিউট অব টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে ডিপ্লোমা শেষ করে গাজীপুরের সুপ্রিম স্টিচ লিমিটেড নামের গার্মেন্টসে প্রোডাক্ট কোয়ালিটি বিভাগে চাকরি নেন।
একই বছরে তিনি গাজীপুরের ব্যবসায়ী মো. ফখরুদ্দিনের মেয়ে মোসাম্মৎ শারমিন আক্তারকে বিয়ে করেন। তাদের তিন বছর বয়সী আয়েশা সিদ্দিকা নামে একটি মেয়ে আছে।
ছমেছ উদ্দিনের একমাত্র মেয়ে মোসাম্মৎ শিরিনা খাতুন (৩৫) দিনাজপুরের পার্বতীপুরের ব্যবসায়ী মজিদুল ইসলাম মিলনের স্ত্রী। তিনি সেখানে স্বামী-সন্তান নিয়ে বসবাস করছেন।
আমেনা বেগম জানান, গত ২ আগস্ট শুক্রবার ভোরে প্রতিদিনের মতো ছমেছ উদ্দিন মসজিদে গিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করেন এবং বাসায় ফিরে কুরআন তিলাওয়াত করেন।
‘তার মিষ্টি গলায় কুরআন তেলাওয়াত শোনা আমার প্রতিদিনের অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। এখন আর শুনি না... তিনি আল্লাহর কাছে চলে গেছেন,’ কাঁদতে কাঁদতে বলেন আমেনা বেগম।
ছমেছ উদ্দিন জমিতে দুইজন শ্রমিককে কাজে লাগান এবং পরে দোকান খোলেন। সকাল ১১টার দিকে গাজীপুরে কর্মরত ছেলেকে ফোন করে তার নাতনি আয়েশার সঙ্গে কথা বলেন। আয়েশা তাকে বারবার রংপুরে নিয়ে যাওয়ার আবদার জানায়।
‘মনে হয়, মহান আল্লাহ তার শেষ দিনটায় নাতনির সঙ্গে কিছুটা সময় কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছিলেন,’ বলেন আমেনা বেগম।
সেদিন দুপুরে জুমার নামাজ শেষে দোকান খুলে পথচারীদের সঙ্গে কথা বলছিলেন তিনি। বিকেলের আগে পুঁটিমাছ ভাজা দিয়ে ভাত খেয়ে মজুরদের মজুরি পরিশোধ করেন। তারপর আসরের নামাজ পড়ে আবার দোকানে বসেন তিনি।
মাগরিবের নামাজও দোকানেই আদায় করেন। সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটের দিকে হঠাৎ মোটরসাইকেলে করে ৫-৬ জন পুলিশ সদস্য এসে দোকানের সামনে থামে।
‘আমার স্বামী দোকানের পেছনের দরজা দিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন। পুলিশ তখন চারদিকে তাকে খোঁজাখুঁজি শুরু করে,’ বলেন আমেনা বেগম।
৬-৭ মিনিট পর তিনি বাড়ি থেকে দক্ষিণ দিকে নাজিরেরহাট-শ্যামপুর রোডে এসে দাঁড়ান। সেখানে পুলিশ তাকে দেখে ধাওয়া করে। তিনি প্রাণ বাঁচাতে দৌড়ান, কিন্তু হঠাৎ রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন।
এ সময় পাশ দিয়ে যাওয়া একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা তাকে দেখে থেমে যায়। চালক ও যাত্রীরা চিৎকার করে মানুষ ডাকেন।
স্থানীয়রা এসে তাকে অচেতন অবস্থায় বাড়িতে নিয়ে আসে এবং সেখান থেকে নগরীর প্রাইম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক সন্ধ্যা ৭টা ৫০ মিনিটে তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
রাত ৮টা ৩০ মিনিটে হাসপাতাল থেকে মরদেহ বাড়িতে আনা হলে আশপাশের শত শত মানুষ ছুটে আসেন তাকে শেষবার দেখতে।
গাজীপুর থেকে আশিকুর খবর পান রাত ৮টার দিকে। তখন প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিল। স্ত্রী-সন্তানসহ বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে রাত ১০টায় নবীল পরিবহনের একটি বাসে রওনা হন এবং ফজরের আগেই বাড়ি পৌঁছান।
৩ আগস্ট সকাল ৯টায় নাজিরেরহাট জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সকাল ১০টায় তাকে স্থানীয় বাগানবাড়ী কবরস্থানে দাফন করা হয়।
আশিকুর বলেন, ‘আমার বাবার শাহাদাতের পর আমি চাকরি ছেড়ে দিয়ে মায়ের সঙ্গে এই বাড়িতেই থাকছি। সবাই বাবার জন্য দোয়া করবেন।’
আমেনা বেগম বলেন, ‘স্বামী ছাড়া জীবন কঠিন, কিন্তু আল্লাহর ওপর যিনি এত ভরসা রাখতেন, এমন একজন শহীদের স্ত্রী হতে পেরে আমি গর্বিত।’
স্থানীয় মাদ্রাসা শিক্ষক মো. গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘ছমেছ উদ্দিন ছিলেন অত্যন্ত ভদ্র, বিনয়ী ও ধর্মপরায়ণ মানুষ। তিনি কখনও উচ্চস্বরে কথা বলতেন না। এলাকার মানুষ তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ রাখবে।’
তার মৃত্যু আমাদের মনে করিয়ে দেয়—এই রাষ্ট্রযন্ত্র কতটা নির্মমভাবে সংবেদনশীল নিরীহ মানুষদেরও শত্রুতে পরিণত করতে পারে।
শহীদ ছমেছ উদ্দিনের আত্মত্যাগ ফ্যাসিবাদ ও বৈষম্যমুক্ত দেশ গড়ার সংগ্রামকে আরও জোরদার করে তোলে। তার জীবনযাত্রা যেমন সাধারণ ছিল, তার মৃত্যু তেমনি অসাধারণ।