বাসস
  ০২ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮:৪৭

পর্যটকদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে সুনামগঞ্জের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য

নিলাদ্রী লেক। ছবি: বাসস

।। মোহাম্মদ শাহজাহান চৌধুরী ।।

সুনামগঞ্জ, ২ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস): প্রকৃতির অপার ঐশ্বর্যশালী একটি জেলার নাম সুনামগঞ্জ। মৌসুম ভেদে এ জেলার প্রকৃতি তিনটি রূপ ধারণ করে। যেমন, বর্ষা মৌসুমে বিশালহাওরের জলরাশি আর আকাশের নীলাভ ছাদ। হাওরের এ পাশ থেকে তাকালে মনে হয় অন্যপাশে যেন নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে। আবার হেমন্তে মানে শীতকালে (পৌষ ও মাঘ মাসে) হাওরের সবুজ বুকে নীল আকাশের নীল আর সবুজের মিতালি এবং ফাল্গুন, চৈত্র ও বৈশাখ মাসে হাওর জুড়ে সোনায় মোড়ানো (সোনালি ধান) এযেন রং তুলিকে হার মানানো ছবি। চর্তুদিকে পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধে মনে ভরে ওঠে। এ দৃশ্যগুলো অবশ্যই উপভোগ্য। এমন মনোরম দৃশ্য মানবজীবনকে সার্থক করে তুলে। মন চায় হাওরের সোনালি বুকে হারিয়ে যেতে।

জেলার পর্যটন স্পটগুলোর মধ্যে রয়েছে তাহিরপুর উপজেলায় এশিয়ার বৃহত্তম শিমুল বাগান, নিলাদ্রী লেক (শহিদ সিরাজী লেক), টেকেরঘাট চুনা পাথর খনি প্রকল্প, বারেকের টিলা, টাঙ্গুয়ার হাওর, বিকি বিল (লাল শাপলা), সদর উপজেলার জাহাঙ্গীর নগর ইউনিয়নে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত ঘেঁষা ডলুরায় রয়েছে ৪৮ শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধার সমাধি। পাশেই রয়েছে স্মৃতিসৌধ। জেলার দোয়ারা বাজার উপজেলার বাংলাবাজার ইউনিয়নে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত ঘেঁষা বাশতলা স্মৃতিসৌধ, এর পাশেই রয়েছে উপজাতি অধ্যুষিত পরিছন্ন ঝুমগাঁও। এ জেলায় রয়েছে তিনটি বর্ডার হাট। সদর উপজেলার জাহাঙ্গীর নগর ইউনিয়নে ডলুরা নামক স্থানে বাংলাদেশ-ভারতর সীমান্তে ডলুরা-বালাট বর্ডার হাট, জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলা ভোগলা ইউনিয়নে রিংকু বাগাবাড়ি বর্ডার হাট ও তাহিরপুর উপজেলার লাইড়ের গড়ে শাহিদাবাদ বর্ডার হাট। বর্তমানে এ তিনটি বর্ডার হাট বন্ধ রয়েছে। 

পর্যটন স্পটগুলোতে থাকার ও খাওয়ার তেমন সুব্যবস্থা নেই। পর্যটন স্পটগুলো ঘুরে ভালো থাকা ও খাওয়ার জন্য সুনামগঞ্জ শহরে আসতে হবে।

কোন স্পটে কীভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ যাতায়াত ব্যবস্থা

সড়কপথে: এনা, মামুন, শ্যামলী, হানিফ এবং বিভিন্ন বাস সায়েদাবাদ, মহাখালী ও ফকিরাপুল থেকে চলাচল করে। সুনামগঞ্জ পৌঁছে পছন্দের বাহন দিয়ে বিভিন্ন স্পটে যাওয়া যায়।

রেলপথে: ঢাকা থেকে সিলেট। এরপর সিলেট থেকে বাসে সুনামগঞ্জ। অপরদিকে ঢাকা থেকে মোহনগঞ্জ পর্যন্ত গিয়ে তারপর অটো, বাইক বা  লেগুনায় ধর্মপাশা বা মধ্যনগর যেতে হয়। ধর্মপাশা বা মধ্যনগর থেকে হেমন্তে  মৌসুমে বাইকে  যেতে পারেন সুনামগঞ্জের উল্লেখযোগ্য পর্যটন স্পট তাহিরপুরে। আর বর্ষা  মৌসুমে  নৌপথে  যেতে পারেন।

বর্ষা মৌসুমে সুনামগঞ্জে পর্যটকের আনাগোণা বেড়ে যায় অনেক বেশি। কারণ, টাঙ্গুয়ার হাওর এর অপরূপ বৈচিত্রের টানে পর্যটকরা ছুটে যান সেখানে। এছাড়া শিমুল ফুলের দিনেও অনেকে সেখানে ঘুরতে যান। আর সারা বছর তো কমবেশি ভ্রমণপিপাসু মানুষদের যাতায়াত থাকেই। টাঙ্গুয়ার হাওর কিংবা শিমুল বাগান ছাড়াও সেখানে রয়েছে দেখার মতো আরও অনেক কিছু।

উপজেলাভিত্তিক দর্শনীয় স্থানসমূহ:

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা: গৌরারাং জমিদার বাড়ি, ডলুরা সমাধিসৌধ ও নারায়ণতলা, সুনামগঞ্জ শহরে পুরাতন কালেক্টরেটে সুনামগঞ্জ ঐতিহ্য জাদুঘর, হাসন রাজার বাড়ি, শহরতলীর ধারারগাঁওয়(হালুয়ারঘাট খেয়াঘাট সংলগ্ন) রয়েছে সুরমা ভ্যালি ডিসি পার্ক, ডলুরা বর্ডার হাট (বর্তমানে বন্ধ রয়েছে)।

সুনামগঞ্জ ঐতিহ্য জাদুঘর ও সুরমা ভ্যালি ডিসি পার্কে ২০ টাকা করে টিকিটে কেটে প্রবেশ করতে হয়। ঐতিহ্য জাদুঘর শহরের প্রাণ কেন্দ্রে এবং সুরমা ভ্যালি ডিসি পার্ক শহরতলীতে অবস্থিত। সুরাম ভ্যালি ডিসি পার্কে রয়েছে শিশুদের জন্য দোলনা, মিনি সুইমিংপুল ও নানান রঙের ফুল। এছাড়াও রয়েছে ক্যান্টিন।

তাহিরপুর উপজেলা: টাঙ্গুয়ার হাওর,বারেকের টিলা, যাদুকাটা নদী, নীলাদ্রী বা শহিদ সিরাজ  লেক, শিমুল বাগান,-লাউড়ের গড়, লালঘাট ঝরনা, লাকমা ছড়া, রাজাই ঝরনা, হাওলি জমিদার বাড়ি, শ্রী প্রভু ওদৈত্ব আশ্রম। এসব স্থানের নৈসর্গিক উপভোগ করতে সবচেয়ে উত্তম সময় বর্ষাকাল। বর্ষাকালে হাউজ বোটে সুনামগঞ্জ ও তাহিরপুর থেকে এ হাউজ বোটগুলো দিয়ে হাওরে রাত্রিযাপন করা যায়। এক্ষেত্রে রিসোর্ট বা হোটেলের প্রয়োজন পড়বে না। হাউজ বোটগুলোতে রয়েছে ক্যাবিন সিস্টেম।  তবে শিমুল বাগানের উপভোগ্য শিমুল ফুলে ঘ্রাণ পেতে হলে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি আসতে হবে।

কোথায় থাকবেন: শিমুল বাগান, বারেকের টিলা, টেকেরঘাট ও টাঙ্গুয়ার হাওর এ পর্যটন স্পটগুলো ঘুরে টেকেরঘাটে হিজল রিসোর্ট আছে। এ রিসোর্টে রাত্রিযাপনসহ খবারের ব্যবস্থাও আছে। প্রয়োজন অনুযায়ী অর্ডার দিয়ে হিজল রেস্টুরেন্টেই খাবার খেতে পারবেন।

রিসোর্টে ভিআইপি কক্ষের ভাড়া নেওয়া হয় আড়াই হাজার টাকা (এসি), এ কক্ষে দুটি ডবল খাটে ৪ জন থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। ডবল কক্ষের ভাড়া ২ হাজার টাকা এবং কাপল বেডের ভাড়া প্রতিদিনের জন্য দেড় হাজার টাকা।

জগন্নাথপুর উপজেলা: পাইলগাও জমিদার বাড়ি, নলুয়ার হাওর, রাধারমন দত্তের বাড়ি। ঢাকা থেকে সরাসারি বাসে জগন্নাথপুর। জগন্নাথপুর নেমে বাসস্টেন্ড-এ স্থানীয়দের জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেব রামারমন দত্তের বাড়ি এবং পাইলগাও যাওয়ার পথ।

দিরাই উপজেলা: ভাটিপাড়া জমিদার বাড়ি, জমিদার বাড়ির ৩ শত বছরের পুরনো মসজিদ, একুশে পদকপ্রাপ্ত বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের বাড়ি, চাপতির হাওর, বরাম হাওর ও কালিকোটা হাওর। হাওরের নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে বর্ষা মৌসুম উত্তম সময়। তবে হেমন্তে হাওরের দুটি রূপ দেখতে পাওয়া যায়। সবুজ ও সোনালি। ঢাকা সায়েদাবাদ ও ফকিরাপুল থেকে বাসে সরাসরি দিরাই যাওয়া যায়। দিরাই থেকে গাড়ি, সিএনজি ও মোটরসাইকেলে শাহ আব্দুল করিমের বাড়ি যাওয়া যায়। দিরাই থেকে সিএনজি অথবা মোটরসাইকেলে ভাটিপাড়া যাওয়া যায়। বর্ষা মৌসুমে দিরাই থেকে নৌকায় যাওয়া যায়। তবে, সিএনজি, মোটরসাইকেল অথবা নৌকায় যেতে ভাড়া দাম-দর করে গেলেই ভালো হয়।

দোয়ারাবাজার উপজেলা: বাঁশতলা শহীদ মিনার (স্মৃতি সৌধ), জুমগাঁও।ঢাকা থেকে বাসে সুনামগঞ্জ অথবা ছাতক এসে গাড়ি দিয়ে যাওয়া যায়।

ধর্মপাশা উপজেলা: সুখাইড় জমিদার বাড়ি। ঢাকা থেকে নেত্রকোনা হয়ে ধর্মপাশা। ধর্মপাশা থেকে হেমন্তে মোটরসাইকেল এবং বর্ষা মৌসুমে নৌকায় যাওয়া যায়।

টাঙ্গুয়ার হাওর: সুনামগঞ্জ জেলার মধ্যনগর ও তাহিরপুর উপজেলার ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত টাঙ্গুয়ার হাওর। ২০০৩ সালের ৯ নভেম্বর থেকে হাওরের নিয়ন্ত্রণ নেয় জেলা প্রশাসন। প্রায় ১২৬ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত টাঙ্গুয়ার হাওর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি। স্থানীয় লোকজনের কাছে হাওরটি নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল নামেও পরিচিত। এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট।

বর্ষা মৌসুমে টাঙ্গুয়ার হাওরের নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগের বিষয় হয়ে দাড়ায়। বর্ষায় আকাশ, মেঘালয় পাড়া আর হাওরের জল ত্রিমুখি সৌন্দের্যের মেলবন্ধেনে অপরূপ দেখায় হাওরটিকে। পুর্ণিমা রাতে এ হাওরে জ্যোৎস্না উৎসব হয়।

বর্ষায় টাঙ্গুয়ার হাওরকে ঘিরে শতাধিক বিলাশ বহুল হাউজ বোট সুনামগঞ্জ ও তাহিরপুর থেকে পর্যটকদের নিয়ে চষে বেড়ায়। হাউজ বোটগুলো রুম প্রতি ভাড়া নেয় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা (দুইদিন ও এক রাতের জন্য)। সকালে সুনামগঞ্জ অথবা তাহিরপুর থেকে টাঙ্গুয়ার হাওরের ওয়াচ টাওয়ার, টেকেরঘাট, নিলাদ্রী লেক, শিমুল বাগান ঘুরে পরদিন সুনামগঞ্জ অথবা তাহিরপুর এসে পৌঁছে।

শনিরাব (২৮ ডিসেম্বর) শিমুল বাগান, টেকের ঘাট, নিলাদ্রী লেক ঘুরতে গিয়ে দেখা গেছে পর্যটকদের।  এ সময় নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার রাকিব হোসেনের সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। রাকিব বাসস’কে জানান, তিনি নিলাদ্রী লেক, টেকেরঘাট পরিত্যক্ত চুনাপাথর খনি প্রকল্প দেখে শিমুল বাগান এসেছেন। রাস্তা-ঘাট ভাঙ্গাচুরা। বারেকেট টিলা, নিলাদ্রী লেকে পর্যটকদের জন্য শৌচাগার নেই।

নিলাদ্রী লেকের মাঝি নাছির উদ্দিন বাসসকে জানান, তিনি গত ৮ বছর ধরে লেকে নৌকা চালিয়ে জবীন-যাপন করছেন। নৌকাগুলো ৫০ থেকে ২০০ টাকা ভাড়া নেওয়া হয়। (সময় বেধে এসব ভাড়া নেওয়া হয়, কে কত সময় ঘুরবেন)। তিনি আরো জানান, এক্ষেত্রে পর্যটকরা নৌকা ভাড়া দাম-দর করে নিলে ভাল হয়।

সুনামগঞ্জ স্থানীয় সরকার বিভাগের (এলজিইডি’র) নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন বাসসকে জানান, শিমুল বাগান, বারেকেরটিলা, নিলাদ্রী লেক, টেকেরঘাট সড়কে কাজ শুরু হয়েছে। এ মৌসুমেই এ সড়কটির কাজ শেষ হবে বলেও জানান নির্বাহী প্রকৌশলী।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বাসসকে জানান, সুনামগঞ্জে পর্যটনের বিকাশে জেলা প্রশাসন নানাবিধ উদ্যোগ নিয়েছে।

তিনি জানান, তাহিরপুরের টেকেরঘাট এলাকায় পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে এলজিইডির বিভিন্ন প্রজেক্টের মাধ্যমে রাস্তার সংস্কার কাজ চলমান রয়েছে। উপজেলার বিন্নাকুলী থেকে কারেন্টের বাজার পর্যন্ত রাস্তাটি দুইটি প্যাকেজের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে। একটি প্যাকেজ অনুমোদন হয়েছে। আরেকটি অনুমোদনের অপেক্ষাধীন রয়েছে। এছাড়া তাহিরপুর থেকে টেকেরঘাট পর্যন্ত রাস্তাটি পাঁচটি প্যাকেজের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে। প্যাকেজগুলো অনুমোদনের পর্যায়ে রয়েছে।

জেলা প্রশাসক আরো জানান, টেকেরঘাট এলাকায় পর্যটকদের জন্য আধুনিক ওয়াশব্লক নির্মাণ করার জন্য পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। খুব শিগগিরই বাস্তবায়ন করা হবে।

টাঙ্গুয়ার হাওরকে ঘিরে হাউজবোটভিত্তিক পর্যটন শিল্প গড়ে উঠায় সকল হাউজবোটকে রেজিস্ট্রেশনের আওতায় আনা হচ্ছে। সকল হাউজবোটে প্রশিক্ষিত গাইড দেওয়ার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য টেকেরঘাটে  নির্মাণ করা হবে বর্জ্য ডাম্পিং স্টেশন।

এছাড়াও পর্যটন এলাকায় চলাচলরত মোটরসাইকেল এবং স্প্রিডবোট চালককে রেজিস্ট্রেশনের আওতায় এনে নির্দিষ্ট পোশাক নির্ধারণ করার পরিকল্পনা হাতে  নেওয়া হয়েছে।

টাঙ্গুয়ার হাওরের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র রক্ষার্থে ওয়াচ টাওয়ার কাম টাঙ্গুয়ার হাওর ম্যানেজমেন্ট অফিস নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে বলেও জানান জেলা প্রশাসক।

তিনি আরো জানান, বারেকের টিলায় মুনভিউ পয়েন্ট নির্মাণ করার কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও হাওরপারের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে চালু করা হবে ভাসমান বাজার।