শিরোনাম
।। মোহাম্মদ শাহজাহান চৌধুরী ।।
সুনামগঞ্জ, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫(বাসস) : এসেছে বসন্ত। সেজেছে শিমুল বাগান। এক কথায় বসন্তের ফুল শিমুল। বসন্তের আগমনের জন্য ফোটার অপেক্ষায় থাকে শিমুল ফুল। বসন্তের আগমনে শিমুলগাছ যেন লালে লাল হয়ে আছে। আগুনরাঙা ফুলে ছেয়ে গেছে পুরো শিমুল বাগান। ফুলের পাপড়ি ঘাসের জমিনে পড়ে যেন লাল কার্পেটে রূপ নিয়েছে।
সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার যাদুকাটা নদীর পশ্চিম পাড়ে মানিগাঁও এলাকায় এ শিমুল বাগানের অবস্থান। যাদুকাটা নদীর তীর ঘেঁষে থাকা এ বাগান এখন পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় জায়গা। এখানে একই সঙ্গে রয়েছে নদী ও পাহাড়ের মেলবন্ধন।
শিমুলবাগানে ফুল ফোটার অপেক্ষায় থাকেন অনেকে। খবর নেন বিভিন্ন মাধ্যমে। আবার কেউ কেউ অপেক্ষায় থাকেন পয়লা ফাল্গুনের। বাসন্তী সাজে সেজে ছুটে আসেন জেলার রূপের নদী যাদুকাটার তীরে থাকা নয়নাভিরাম জয়নাল আবেদীন শিমুলবাগানে। কেউ আসেন পরিবার পরিজন নিয়ে। আবার কেউবা প্রিয় মানুষকে সঙ্গে নিয়ে আসে, আবার একা এসে নিজেই নিজেকে খোঁজে ফেরেন প্রকৃতির মধ্যে।
শীতের শেষে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পর্যটকেরা আসেন এ সময়। বাগানে ঘুরে বেড়ান। ছবি তোলেন। তরুণ-তরুণীরা দল বেঁধে গানে মাতেন। শাহ আবদুল করিম, হাছন রাজা, দুর্বিন শাহের গানের সুর ছড়িয়ে পড়ে বাগানজুড়ে। কেউ গাছের ছায়ায় বসে থাকেন; নিরিবিলি সময় কাটান। কেউ বাগানে ঝরে পড়া ফুল কুড়ান।
শুধু বড়দেরই নয়, শিশুরাও আসে শিমুলবাগানে। আনন্দে মেতে ওঠে তারা। দৌড়াদৌড়ি, ঘোড়ায় চড়ে, দোলনায় দুলে পাহাড় দেখে সবাই আনন্দ পায়। শুধু শিশুরাই ঘোড়ায় চড়ে না। বড়রাও ঘোড়ায় চড়ে।
মঙ্গলবার বিকেলে শিমুল বাগানে গিয়ে এ প্রতিবেদকের দেখা হয় ময়মনসিংহ থেকে আসা চার বন্ধুর সঙ্গে। ৪ বন্ধুর একজন মুক্তাদির ইসলাম মহিম। তিনি বাসসকে জানান, ময়মনসিংহ থেকে তারা ৪ বন্ধু প্রথমে বাসে মোহনগঞ্জ আসেন। পরে মোহনগঞ্জ থেকে দুটি মোটরসাইকেলে করে একাধারে তিনঘণ্টা পথ পাড়ি দিয়ে শিমুল বাগান এসে পৌঁছেন।
রাস্তা অত্যন্ত খারাপ থাকায় তাদের খুব কষ্ট হয়েছে। মহিম জানান, শিমুল বাগানের সৌন্দর্য দেখে মন ভরে গেছে তাদের। তবে রাস্তা খারাপ হওয়ার কারণে ফিরে যেতে তাদের কষ্ট হবে।
মহিমের বন্ধু আহমেদুল বাসসকে জানান, শিমুল বাগানকে ঘিরে আবাসিক হোটেল বা রিসোট নেই। প্রায় ২/৩ কিলোমিটার দূরে বাদাঘাট বাজারে আসাবিক হোটেল রয়েছে। সেগুলো তাদের পছন্দ হয়নি। ভালো আবাসিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য তিনি স্থানীয়দের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
ঢাকা থেকে আসা সোহেল মোরশেদ বাসসকে জানান, শিমুল বাগানসহ পর্যটন স্পটগুলো ঘুরে দেখতে প্রশিক্ষিত গাইড নেই। প্রশিক্ষিত গাউড হলে তারা পর্যটকদের কথা বুঝবে। এখানে নিএনজি চালক ও মোটরসাইকের রাইডার যারা আছেন তারা পর্যটকদের ভাষা বুঝেন না। এটা একটা বড় সমস্যা। প্রশিক্ষিত গাইড হলে তারা পর্যটকদের কথা বুঝবে। পর্যটকদেরও তারা বুঝাতে পারবে।
সোহেল মোরশেদ আরও জানান, তিনি প্রথমে ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ এসেছেন। পরে তিনি সুনামগঞ্জে থেকে শিমুল বাগানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার মূল রাস্তা থেকে কানেক্টিং রোডের অবস্থা অত্যন্ত্য রাখাপ।
সোহেল মোরশেদ জানান, শিমুল বাগানে একটি মাত্র ক্যন্টিন রয়েছে। এ ক্যন্টিনে খাবারের মূল্য বেশি। আরও কয়েকটা ক্যন্টিন হলে পর্যটকদের জন্য ভালো হতো।
ঢাকা থেকে আসা মাহরুবা খানম নামের এক নারী পর্যট বাসসকে জানান, শিমুল বাগানসহ এখানকার রাস্তা খুবই খারাপ। তিনি আরও জানান, শিমুল বাগারে নারীদের জন্য ভালো মানের ওয়াশরুম নেই। একই সঙ্গে ড্রেস চেঞ্জ রুম থাকলে ভালো হত।
সিলেট শাহপরান থেকে পরিবার পরিজন নিয়ে শিমুল বাগানে ঘুরতে বেসরকারি চাকরীজীবী মো. সরওয়ার কামাল চৌধুরী বাসসকে শিমুল বাগানে নামাজের ব্যবস্থা নেই। নামাজের ব্যবস্থা থকেলে ভালো হতো। তিনি আরও জানান, এখানে মোটরসাইকেল, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার ভাড়া নির্ধারণ করা নেই। এসব যানবাহানের চালকরা ইচ্ছে মতো পর্যটকদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করছে।
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, সিলেটের রাতারগুল, জাফলং, বিছানাকান্দি, লালাখাল এসব পর্যটন এলাকায় নৌকা, মোটরসাইকেল ও অটোরিকশা ভাড়া নির্ধারণ করা আছে।
ওইসব পর্যটন স্পটের মতো শিমুল বাগানসহ বিভিন্ন পর্যটন স্পটে এক স্পট থেকে অন্য স্পটে যেতে ভাড়ার তালিকা জনসমক্ষে সাইনবোর্ড আকারে ঝুলিয়ে রাখলে পর্যটকদের জন্য ভালো হয়।
শিমুল বাগানের ম্যানেজার ফরিদ গাজী বাসসকে জানান, বসন্তের আগমনে শিমুল বাগানে তুলনামূলক বেশি পর্যটক আসছেন। প্রতিদিন গড়ে ৫শত থেকে ৭শ’র মতো পর্যটক আসেন। তবে টিকেট কাটেন অন্তত আড়াই থেকে তিনশত জন পর্যট। অন্যরা স্থানীয়, বিভিন্ন পরিচিত লোক, বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তার স্বজন।
ফরিদগাজী আরও জানান, স্থানীয় ও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পহেলা ফাল্গুন শিমুল বাগানে অন্তত ৫ থেকে ৭ হাজার পর্যটক এসেছেন। এর মধ্যে টিকেট কেটেছেন মাত্র এক হাজার পর্যটক। তিনি জানান, স্থানীয় লোকজন, সাংবাদিক, প্রশসনের লোকদের টিকেট ছাড়াই শিমুল বাগানে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। তাদের কাছ থেকে প্রবেশ মূল্য (টিকেট কাটতে হয় না) নেওয়া হয় না।
ফরিদ গাজী জানান, শিমুল বাগান রক্ষণাবেক্ষণে ৪৫ জন কর্মী রয়েছেন। এসব কর্মীরা যাতে কোন পর্যটক বাগানের ফুল ছিড়তে না পারে ও ডাল ভাঙ্গতে না পারে সেটি দেখা শোনার পাশাপাাশি বাগানের ভেরত পর্যটকদের কোন সমস্য হল কিনা সেটাও দেখেন।
তিনি আরও জানান শিমুল ফুল ফুটতে শুরু করে ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে এবং গাছের ডালে থাকে অন্তত ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
শিমুল বাগান ঘুরে দেখতে রয়েছে অন্তত ১৮টি ঘোড়া। ৫০ থেকে শুরু করে ২শত টাকায় সম্পূর্ণ শিমুল বাগান ঘোড়ায় চড়ে দেখা যায়। এক্ষেত্রে ঘোড়ার মালিকদের সাথে দাম-দর করে নিলে ভালো হয়।
শিমুল বাগানের মালিক রাখাব উদ্দিন বাসসকে জানান, তার বাবা জয়নাল আবেদীন ২০০৩ সালে তাহিরপুর উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় শখের বসে ৩০ একর জায়গা নিয়ে এ শিমুল বাগানটি করেন। বর্তমানে এ বাগানে সাড়ে ৩ হাজার শিমুল গাছ রয়েছে।
পর্যটকদের সুবিধার্থে বাগানে শৌচাগার করা হয়েছে। সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। টিউবওয়েল বসিয়ে দিয়ে টেপ দেওয়া হয়েছে। ছাউনি নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে বলেও জানান রাখাব উদ্দিন।
শিমুল বাগান কীভাবে যাবেন : ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ যাতায়াত ব্যবস্থা।
সড়কপথে : এনা, মামুন, শ্যামলী, হানিফ এবং প্রভৃতি বাস সায়েদাবাদ, মহাখালী ও ফকিরাপুল থেকে চলাচল করে। সুনামগঞ্জ পৌঁছে পছন্দের বাহন দিয়ে বিভিন্ন স্পটে যাওয়া যায়।
রেলপথে : ঢাকা থেকে সিলেট। এরপর সিলেট থেকে বাসে সুনামগঞ্জ। অপরদিকে ঢাকা থেকে মোহনগঞ্জ পর্যন্ত গিয়ে তারপর অটো, বাইক বা লেগুনায় ধর্মপাশা বা মধ্যনগর যেতে হয়। ধর্মপাশা বা মধ্যনগর থেকে হেমন্তে মৌসুমে বাইকে যেতে পারেন সুনামগঞ্জের উল্লেখযোগ্য পর্যটন স্পট তাহিরপুরে। আর বর্ষা মৌসুমে নৌপথে যেতে পারেন।
কোথায় থাকবেন : শিমুল বাগান, বারেকের টিলা, টেকেরঘাট ও টাঙ্গুয়ার হাওর এ পর্যটন স্পটগুলো ঘুরে টেকেরঘাটে হিজল রিসোর্ট আছে। এ রিসোর্টে রাত্রিযাপনসহ খবারের ব্যবস্থাও আছে। প্রয়োজন অনুযায়ী অর্ডার দিয়ে হিজল রেস্টুরেন্টেই খাবার খেতে পারবেন। এ রিসোর্টে সকালের নাস্তা ফ্রি দেওয়া হয় বর্ডারদের।
রিসোর্টে ভিআইপি কক্ষের ভাড়া নেওয়া হয় আড়াই হাজার টাকা ( এসি), এ কক্ষে দুটি ডবল খাটে ৪ জন থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। ডবল কক্ষের ভাড়া ২ হাজার টাকা এবং কাপুল বেডের ভাড়া প্রতিদিনের জন্য দেড় হাজার টাকা।
সুনামগঞ্জ স্থানীয় সরকার বিভাগের (এলজিইডি’র) নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন বাসসকে জানান, শিমুল বাগান, বারেকেরটিলা, নিলাদ্রী লেক, টেকেরঘাট সড়কে কাজ শুরু হয়েছে। এ মৌসুমেই এ সড়কটির কাজ শেষ হবে বলেও জানান নির্বাহী প্রকৌশলী।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বাসসকে জানান, সুনামগঞ্জে পর্যটনের বিকাশে জেলা প্রশাসন নানাবিধ উদ্যোগ নিয়েছে। তিনি জানান, শিমুল বাগানসহ বিভিন্ন স্পটে পর্যাপ্ত ওয়াশ ব্লক, ড্রেস চেঞ্জ রুম এ মৌসুমেই করা হবে।
তিনি আরও জানান, পর্যটন স্পটগুলোকে ঘিরে মোটরসাইকেল, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিশার ভাড়ার নির্ধারণ করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
পর্যটকদের জন্য : জেলা প্রশাসক জানান, তাহিরপুরের টেকেরঘাট এলাকায় পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে এলজিইডির বিভিন্ন প্রজেক্টের মাধ্যমে রাস্তার সংস্কার কাজ চলমান রয়েছে। উপজেলার বিন্নাকুলী থেকে কারেন্টের বাজার পর্যন্ত রাস্তাটি দুইটি প্যাকেজের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে। একটি প্যাকেজ অনুমোদন হয়েছে। আরেকটি অনুমোদনের অপেক্ষাধীন রয়েছে। এ ছাড়া তাহিরপুর থেকে টেকেরঘাট পর্যন্ত রাস্তাটি পাঁচটি প্যাকেজের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে। প্যাকেজগুলো অনুমোদনের পর্যায়ে রয়েছে।
জেলা প্রশাসক আরও জানান, টেকেরঘাট এলাকায় পর্যটকদের জন্য আধুনিক ওয়াশব্লক নির্মাণ করার জন্য পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। খুব শিগগিরই বাস্তবায়ন করা হবে।
জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া আরও জানান, বারেকের টিলায় মুনভিউ পয়েন্ট নির্মাণ করার কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও হাওরপারের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে চালু করা হবে ভাসমান বাজার।