বাসস
  ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৯:৪৭
আপডেট : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২১:৩২

স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের ওপর ড. জাহিদের গুরুত্বারোপ

প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেছেন, বাংলাদেশ একতরফাভাবে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে তার উত্তরণের সময়সীমা পিছিয়ে দিতে পারে না।

তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘের উন্নয়ন নীতি কমিটি (ইউএন-সিডিপি) ২০২১ সালে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের সুপারিশ করেছিল। এই সুপারিশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে উত্তরণ কার্যকর না করলেও, এটিকে মূলত বাধ্যতামূলক বলেই মনে করা হয়। কারণ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ সিডিপি’র সুপারিশ অনুসরণ করে।’

জাহিদ হোসেন সম্প্রতি তার বাসভবনে জাতীয় সংবাদ সংস্থার সাথে এক সাক্ষাৎকারে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) অবস্থান থেকে দেশের উত্তরণের বিষয়ে এভাবেই তার মতামত তুলে ধরেন।

ড. জাহিদ বলেন, উত্তরণ প্রক্রিয়া চলাকালীন বিপর্যয়ের সম্মুখীন হওয়া বেশ কয়েকটি দেশকে উত্তরণ হওয়ার আগে বর্ধিত প্রস্তুতিমূলক সময় দেয়া হয়েছিল।

তিনি আরো বলেন, তাদের চিহ্নিত যে কোনো উদ্বেগ বা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে অতিরিক্ত সময় দেয়া হয়। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই দুই বছরের বর্ধিত সময় পেয়েছে। ২০২৬ সালে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ সম্পর্কে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের আপত্তির জবাবে ড. জাহিদ স্পষ্ট করে বলেন, একবার কোনও দেশ উত্তরণ হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করলে, সমস্ত উদ্বেগের যথাযথ সমাধান নিশ্চিত করার দায়িত্ব সেই দেশের ওপরই বর্তায়।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ যখন ২০২৬ সালে উত্তরণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের উদ্বেগগুলো সমাধান করা ও একটি সহজ উত্তরণ নিশ্চিত করা দেশটির জন্য অপরিহার্য।

বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ এ ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গিগুলো তুলে ধরেছেন- যা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের সামনে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ রয়েছে, সে ব্যাপারে একটি সার্বিক ধারণা পাওয়া যায়।

বিষয়টি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করে ড. জাহিদ বলেন, ‘এখন আমি মনে করি তথ্য ও পরিসংখ্যানগত পরিবর্তনের মাধ্যমে দেশের এই উত্তরণ পিছিয়ে দেয়ার সুযোগ সীমিত। মাথাপিছু আয়, মানব উন্নয়ন ও দুর্বলতা সূচকের পরিসংখ্যাণকে সীমার নীচে নামিয়ে আনার সুযোগও কম।’

তিনটি মানদণ্ড পূরণ করে উত্তরণের জন্য সুপারিশকৃত দেশ হিসেবে বাংলাদেশই প্রথম দেশ- উল্লেখ করে ড. জাহিদ বলেন, ‘আমাদের মেনে নিতে হবে যে, আমরা উত্তরণ হব এবং আমাদের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সম্ভাব্য প্রভাব মোকাবেলা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেব। এ ব্যাপারে আমাদের প্রস্তুত থাকা উচিত।’

আবুধাবিতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সর্বশেষ মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে মন্ত্রীরা সিদ্ধান্ত নেন যে, নিম্নোক্ত দেশগুলো থেকে উত্তরণ পর্যায়ের দেশগুলোর জন্য স্বল্পোন্নত বাণিজ্য সুবিধা আরও তিন বছরের জন্য অব্যাহত রাখা হবে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ২০২৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য স্বল্পোন্নত বাণিজ্য সুবিধা অব্যাহত রাখবে এবং নিম্নোক্ত দেশগুলোর জন্য তিন বছরের অতিরিক্ত সময়সীমা প্রদান করবে।

কানাডা, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার মতো আরও কয়েকটি দেশও উত্তরণ পর্যায়ের পরেও বাংলাদেশের জন্য স্বল্পোন্নত বাণিজ্য সুবিধা অব্যাহত রাখবে।

অনেকেই বাংলাদেশকে ইতোমধ্যেই যে ‘মধ্যম আয়ের ফাঁদে’ পড়ার আশঙ্কা করছেন- সে সম্পর্কে জানতে চাইলে ড. জাহিদ বলেন, যদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও কাঠামোগত অর্থনৈতিক সংস্কার নিশ্চিত করা না হয়, তাহলে আর কোন কিছুই আমাদের এই ফাঁদ থেকে বের করে আনতে পারবে না।

তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের তিনটি ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে হবে- বিশেষ করে রপ্তানিতে বৈচিত্র, বিনিয়োগ ও দক্ষতা উন্নয়ন। আমাদের সামনে একটি বড় সুযোগ রয়েছে। যা হল- মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন অর্থনৈতিক নীতি।’

এই পরিস্থিতিতে চীনে ব্যবসা পরিচালনাকারী বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসা স্থানান্তরের জন্য বিকল্প স্থান খুঁজছে ... যেমন ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন।

ড. জাহিদ বলেন, অনেকেই বিশ্ব মঞ্চে বাংলাদেশ সম্পর্কে কথা বলছেন ... তবে ভিসা প্রাপ্তির জটিলতা, দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর প্রস্তুতি, ব্যবসায়িক নিয়ন্ত্রণ ও অর্থ প্রত্যাবাসন ইত্যাদির মতো বিনিয়োগ পরিবেশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনও পুরোপুরি প্রস্তুত নয়।

তবে তিনি আশা প্রকাশ করেন, ‘যদি আমরা সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত হতে পারি, তাহলে এফডিআইতে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটতে পারি ও এর ফলে বিপুল সুযোগের দ্বার উন্মুক্ত হবে।’

ড. জাহিদ বলেন, বাংলাদেশ এই গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর বিষয়ে সরকারের সক্রিয় অবস্থান একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। এতে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার পরিবর্তে জরুরিভাবে পাঁচটি সুসজ্জিত অঞ্চল তৈরির দিকে মনোনিবেশ করা হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, ‘এই কৌশলগত পদক্ষেপের লক্ষ্য বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান এবং একটি ‘প্লাগ-এন্ড-প্লে’ পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্কার করা।’

ড. জাহিদ বলেন, ব্যবসায়িক নিয়মকানুন সহজীকরণ এবং এই বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর (এসইজেড) প্রস্তুতি নিশ্চিত করার মাধ্যমে, বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বিদেশী প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) আকর্ষণ করতে এবং দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বৃদ্ধির আশা করতে পারে।

ড. জাহিদ বর্তমান ব্যবসায়িক পরিবেশ নিয়ে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের উদ্বেগের বিষয়ে উত্থাপিত বিষয়গুলোর বাস্তবতা স্বীকার করেন।

তিনি বলেন, আর্থিক খাতের অবস্থা এবং গ্যাস ও বিদ্যুতের অসামঞ্জস্যপূর্ণ সরবরাহ ব্যবসায়িক আস্থা হ্রাসের দুটি প্রধান কারণ।

এছাড়াও বিশ্বব্যাংকের সাবেক এই প্রধান অর্থনীতিবিদ এলএনজি সরবরাহ সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জগুলোও তুলে ধরেন।
তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, ক্রয়মূল্যের নিচে এলএনজি বিক্রি করে সরকার টেকসই সরবরাহ বজায় রাখতে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে।

নতুন মুদ্রানীতি বিবৃতি (এমপিএস) সম্পর্কে ড. জাহিদ বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার নীতি ও কর্মসূচি কীভাবে পরিচালনা করবে, সে সম্পর্কে কিছু ভবিষ্যত নির্দেশনা আসার সম্ভাবনা রয়েছে।

তিনি বলেন, এই বছরের জুনে অর্থ-বছরের বাজেট প্রকাশের মাধ্যমে সকলেই জানতে পারবেন যে, অর্থনৈতিক নীতি ও ব্যবস্থাপনা কোন পথে এগিয়ে যাবে এবং তারপরে আকাশের মেঘ কেটে যাবে।

সরকারের অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি অন্যান্য সংস্কার কর্মসূচির তুলনায় কম গুরুত্ব পাচ্ছে কী না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকার অবশ্যই উপলব্ধি করছে যে, তাদের অর্থনৈতিক সংস্কার বাস্তবায়ন করতে হবে এবং এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু দৃঢ় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও, তারা প্রায়শই সেগুলোকে কর্মে রূপান্তর করতে পারেন না। কারণ উদ্যোগগুলো প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকেই আসে।