বাসস
  ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৮:১৬

সহনীয় অবস্থায় দ্রব্যমূল্য, সরবরাহ শৃঙ্খলা স্বাভাবিক

ফাইল ছবি

॥ গোলাম মঈন উদ্দিন ॥

ঢাকা, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ (বাসস): অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ ও নীতিগত পদক্ষেপের সুবাদে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এখন সহনীয় পর্যায়ে এবং দেশব্যাপী কিচেন মার্কেটে সরবরাহ শৃঙ্খলা স্বাভাবিক রয়েছে। 

পণ্য ও সবজির এই যুক্তিসঙ্গত মূল্য এবং স্বাভাবিক সরবরাহের দিকটি জানুয়ারির সর্বশেষ ভোক্তা মূল্য সূচক (সিপিআই) এ উঠে এসেছে। এতে সাধারণ পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের ডবল ডিজিটের সূচক ১০.৮৯ শতাংশ থেকে কমে গত জানুয়ারিতে ৯.৯৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।  

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এই হ্রাস হয়েছে প্রধানত খাদ্যমূল্য কমার কারণে। 

বিবিএসের তথ্যে দেখা যায়, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে, পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট খাদ্য মূল্যস্ফীতি ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের ১২.৯২ থেকে কমে ১০.৭২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

এদিকে, খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতির হার ২০২৪ এর ডিসেম্বরের ৯.২৬ শতাংশ সামান্য বৃদ্ধি পেয়ে জানুয়ারিতে হয়েছে ৯.৩২ শতাংশ।

শহর ও গ্রামীণ উভয় ক্ষেত্রেই পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট মুদ্রাস্ফীতির হারও কমেছে গত মাসে।

গ্রামীণ এলাকায়, জানুয়ারিতে এটি ছিল ১০.১৮ শতাংশ যা ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ছিল ১১.০৯ শতাংশ।

অন্যদিকে, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে শহরাঞ্চলে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৯.৮৯ শতাংশ যা ডিসেম্বর, ২০২৪ সালে ছিল ১০.৮৪ শতাংশ।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গত ছয় মাসের মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি বিবেচনা করা হলে বোঝা যাবে যে সাধারণ মুদ্রাস্ফীতি এখন ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে এবং এটি কমবেশি স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে।

জুলাই মাসে ১১.৬৬ শতাংশের উচ্চ সাধারণ মূল্যস্ফীতির হারের সাথে এই অর্থবছরের শুরু, যে মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গতি পায় এবং এইভাবে ৫ আগস্ট, ২০২৪-এ স্বৈরাচারী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার দিকে পরিচালিত করে, তখন মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা হ্রাস পেয়ে ১০.৪৯ শতাংশে নেমে আসে।

২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গত ছয় মাসের মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি বিবেচনা করলে অনুধাবন করা যায় যে সাধারণ মূল্যস্ফীতি এখন ধীরে ধীরে বশীভূত হচ্ছে এবং এটি একটি স্থিতিশীল হয়েছে। 

জুলাই মাসে উচ্চ সাধারণ মূল্যস্ফীতি ১১.৬৬ শতাংশের সাথে এই অর্থবছরের শুরু। যখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গতি লাভ করে এবং এর ফলে ক্ষমতাচ্যুত হয় স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা। আগস্টে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমে দাঁড়ায় ১০.৪৯ শতাংশ। 

এরই ধারাবাহিকতায় সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার আরও কমে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে নেমে আসে। তারপরে অক্টোবরে সামান্য বৃদ্ধি পেয়ে ১০.৮৭ শতাংশ এবং নভেম্বরে ১১.৩৮ শতাংশে দাঁড়ায়। এরপর ডিসেম্বরে (২০২৪) সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার কমে আসে ১০.৮৯ শতাংশে। গত মাসে (জানুয়ারি) মূল্যস্ফীতি ডবল ডিজিটের নিচে নেমে গেছে।

৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আশাবাদ ব্যক্ত করেন, সাধারণ পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট মুল্যস্ফীতির হার জুনের মধ্যে ৬-থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে নেমে আসবে। 

তিনি বলেন, ‘সরকারি পদক্ষেপ নেওয়ায় মূল্যস্ফীতি কমতে আরও দুই থেকে তিন মাস সময় লাগবে।

আমরা যদি জুনের মধ্যে মূল্যবৃদ্ধি ৬-৭ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারি, আমরা তা সন্তোষজনক বিবেচনা করব।’

সালেহউদ্দিন বলেন, আসন্ন পবিত্র রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম স্থিতিশীল করতে আরও পদক্ষেপ নেওয়া হবে ।

এদিকে, বাণিজ্য উপদেষ্টা এসকে বশির উদ্দিন ৪ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারে এক অনুষ্ঠানে রমজানে দ্রব্যমূল্য বাড়বে না বলে আশ্বস্ত করেছেন। 

তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি এক ব্যবসায়ী সম্মেলনে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘সবাই একসাথে কাজ করছে। তাই বাজারে পণ্যের দাম বাড়বে না বলে আশা করছি। রমজান মাসে যেকোনো উপায়ে তেল, চিনি, খেজুর, ছোলা, মাছ, মুরগি, ডিম ও মৌসুমি সবজি সরবরাহ অব্যাহত থাকবে।’ 

সম্প্রতি বাসসের সাথে আলাপকালে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ডক্টর জাহিদ হোসেন বলেন, যদি দেশে প্রাকৃতিক বা রাজনৈতিক দুর্যোগ না হয় তাহলে আগামী অর্থবছরে (অর্থবছর ২৬) ৬ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।  

তিনি বলেন, ‘আমার ধারণা, মূল্যস্ফীতি ৬ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে। এখনো বেশ কিছু পণ্যের দাম বাড়ছে। চাল, মসুর ডাল এবং মাছের মতো প্রয়োজনীয় আইটেমের দাম সাধারণ মানুষকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করে, এগুলোর দাম কমাতে হবে।’  

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সংস্থা ও শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রমজানের আগে চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) প্রথম ছয় মাসে বেশির ভাগ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি বেড়েছে।

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি) ধারণা করছে, এ ধরনের পণ্যের দাম স্থিতিশীল থাকবে।

গত মাসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া একটি প্রতিবেদনে বিটিটিসি ১৬টি প্রয়োজনীয় চিহ্নিত করেছে। রমজান মাসে এসব পণ্যের চাহিদা বেশি দেখা যায় যেহেতু লোকেরা ইফতারসহ বিশেষ খাবার এবং ঐতিহ্যগত খাবার প্রস্তুত করে।

বিটিটিসি জানিয়েছে, মসুর ডাল, অপরিশোধিত সয়াবিন তেল, পরিশোধিত চিনি এবং ছোলা আমদানি আগের বছরের তুলনায় জুলাই ১ (২০২৪) এবং ৫ জানুয়ারি (২০২৫) এর মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে।

রমজান মাসে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা আইটেমগুলোর মধ্যে একটি হল ছোলা,এটির আমদানি ১৮৮ শতাংশ বেড়েছে। আগের বছরের তুলনায় এই আমদানি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৮,৯৮০ টন।

ভোজ্য তেলের মধ্যে, বেসরকারি শোধনাগারগুলো ৪০ শতাংশ বেশি অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি করেছে, অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে এই আমদানি ৩.৮৪ লাখ টনে পৌঁছেছে।

তবে পাম তেলের আমদানি আগের বছরের তুলনায় ২৭ শতাংশ কমে ৭.১১ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে।

বিটিটিসি জানিয়েছে, সরকারের এই সিদ্ধান্ত বিশেষ করে আমদানি শুল্ক এবং মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট কমানো সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ঠিক রাখতে নানা উদ্যোগ স্থানীয় বাজারে সাশ্রয়ী মূল্য, আমদানি এবং সরবরাহ শৃঙ্খলে ইতিবাচকভাবে প্রভাব ফেলে।

বিটিটিসি ইঙ্গিত দিয়েছে যে, আন্তর্জাতিক মূল্য এবং আমদানি শুল্ক এবং কর হ্রাসের কারণে রমজানে নিম্নমুখী প্রবণতার কারণে ভোজ্য তেলের দাম কমতে পারে।

আমদানি বাড়ানো এবং মূল্য নিয়ন্ত্রণের প্রয়াসে অন্তর্বর্তী সরকার ভোজ্য তেল, চিনি, পেঁয়াজ, আলু এবং খেজুরসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পণ্যে শুল্ক মওকুফ করেছে।

এছাড়াও, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট প্রশমিত হয়েছে, ক্রেডিট পত্র (এলসি) খোলার পথ পরিষ্কার করেছে।

সম্প্রতি বাসসের সাথে আলাপকালে নগরীর শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা শামীমা সুলতানা বলেন, আশেপাশের এলাকায় কিচেন মার্কেটে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসহ পণ্যের সরবরাহ স্থিতিশীল রয়েছে।

পবিত্র রমজান মাসে যাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ও সরবরাহ স্থিতিশীল থাকে এজন্য তিনি সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলোর কঠোর নজরদারি ও সতর্কতার পরামর্শ দেন।