শিরোনাম
ঢাকা, ১৭ মে, ২০২৩ (বাসস) : কোভিড-১৯ সংক্রমন শুরু হওয়ার পর ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত সময়কালে দেশের দারিদ্র্য হার প্রায় দ্বিগুণে উন্নীত হলেও পরবর্তীতে ২০২২ সালের শুরু থেকে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে। সেই প্রবণতার ধারাবাহিকতায় শেষ পর্যন্ত দেশের দারিদ্র্য হার কমে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে এসেছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত দু’দিনব্যাপী ‘বিআইডিএস রিসার্চ এলামনাক ২০২৩’ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে এসব তথ্য জানান সংস্থার মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, বিশেষ অতিথি পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক ড. শামসুল আলম এবং সম্মানিত অতিথি পরিকল্পনা সচিব সত্যজিত কর্মকার বক্তব্য রাখেন।
মহামারির সময় দেশে দারিদ্র্যের হার ৪২ শতাংশ হয়ে গিয়েছিল বলে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান যে তথ্য প্রকাশ করেছিল, তার সমালোচনা করে অনুষ্ঠানে ড. বিনায়ক বলেন,‘কোভিডের সময় দারিদ্র্য পরিস্থিতি নিয়ে বেশ বিতর্ক হয়েছিল। আমাদের সমগোত্রীয় (গবেষণা প্রতিষ্ঠান) কেউ কেউ তাদের তখনকার ২০২০ এর কাজের ভিত্তিতে বলেছিল যে, দারিদ্র্য প্রায় ডাবল হয়ে গেছে। তিনি মনে করেন তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে তারা ভুল করেছে।
২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেম ২০২০ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে সারাদেশের ৮ বিভাগের ৬৪টি জেলার ৫ হাজার ৫৭৭টি পরিবারের ওপর একটি জরিপ চালিয়ে তখন দেশের দারিদ্র্য হার ৪২ শতাংশে নেমে গেছে বলে জানিয়েছিল। সেটা দেশের গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হয়।
সেই প্রসঙ্গ টেনে ড. বিনায়ক বলেন, ‘সেই সময় দারিদ্র্য হার বাড়লেও সেটা ছিল শুধুমাত্র সাময়িক সময়ের জন্য। এটা ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত বেড়েছিল। জুনের পর থেকে এটা কমে আসা শুরু হয়েছিল।’
তিনি আরও বলেন, এরপর কোভিড, ওমিক্রন, ডেল্টা ইত্যাদি পার হয়ে ২০২২ সালের প্রথম দিক থেকেই দেশের অর্থনীতি স্বাভাবিক প্রবণতায় ফিরে আসতে শুরু করে। তবে মানুষ শুধু যেখানে সেখানে শ্রম দিয়েছে সেই ব্যাপারটা না,বরং সেখানে মানুষের নন-ফার্ম সেল্ফ এমপ্লয়মেন্ট একটা বড় ভূমিকা পালন করেছে।
বিআইডিএস এর সমীক্ষার তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, ওই সময় বেসরকারি এবং সরকারি দুপক্ষই নিজস্ব উদ্যোগে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অর্থায়ন করেছে। এতে তথ্যপ্রযুক্তি এবং কৃষি সম্প্রসারণ প্রযুক্তি কাজে দিয়েছে। এরপর ২০২২ সালের শুরুতে অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে বলে ওই সমীক্ষা থেকে পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি।
বিনায়ক সেন বলেন, ‘২০১৯ এবং ২০২২ এর মধ্যে সামগ্রিক দারিদ্র্যের হার ৪ দশমিক ৩ শতাংশ পয়েন্ট কমেছে। একই সময়ে চরম দরিদ্র পরিবারের সংখ্যাও ৩ দশমিক ২ শতাংশ পয়েন্ট কমে গেছে।’ কোভিড-১৯-এর অভিঘাত মোকাবিলা করে দারিদ্র্য হ্রাসে এটি একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি বলে মন্তব্য করেন এই অর্থনীতিবিদ।
তবে পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ যে দারিদ্র্য হারের কথা বলা হয়েছে সেখানে প্রায় অর্ধেক নতুন দরিদ্র হয়েছে। নিন্ম মধ্যবিত্ত থেকে কোভিডের সময় বিভিন্ন অসুবিধায় পড়ে তারা আবার দারিদ্র্য সীমার নিচে নেমে যায়।
বিদ্যমান এমন পরিস্থিতিতে তিনি এসব নতুন দরিদ্র মানুষকে আবারও দারিদ্র্য সীমার উপরে তুলতে সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেন। বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ঝরে পড়ার হার বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি এসব শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনতে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণের উপর গুরুত্বারোপ করেন। পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর বিভিন্ন কর্মসূচি ঠিকমতো বাস্তবায়ন ও দারিদ্র্য কমাতে বিশেষ অবদান রাখে এমন পদক্ষেপ নেওয়ার দরকার বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, অর্থনীতি ইতিবাচক ধারায় ফিরে আসলেও কালোমেঘ অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে। যেমন বিআইডিএস এর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২৩ দশমিক ৫ শতাংশ চরম দরিদ্র পরিবার বলেছে যে, করোনা মহামারী চলাকালীন তাদের সন্তানদের শিক্ষা বন্ধ করতে হয়েছে।
কোভিডের সময়ে শিক্ষা ও মানবিক পুঁজির বিকাশের ক্ষেত্রে শহরের দরিদ্র শ্রেণি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শহরে দরিদ্রদের শিক্ষার ক্ষতি কমাতে এবং তাদের সন্তানদের শিক্ষার ধারায় পুনরায় ফিরে আসতে একটি বিশেষ শিক্ষা পুনরুদ্ধার কর্মসূচি চালু করা দরকার বলে তিনি উল্লেখ করেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এম এ মান্নান বলেন, কোভিডের সময় নানা প্রতিষ্ঠান নানারকম তথ্য দিয়ে আমাদের দু:চিন্তায় ফেলেছিল। তবে বিবিএস এর সর্বশেষ জরিপের তথ্য অনুযায়ী দারিদ্র্যর যে হার পাওয়া গেল তাতে দেখা যায় আমরা সঠিক পথেই আছি। তবে এখন সবচেয়ে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে বৈষম্য।
মন্ত্রী বলেন, প্রত্যেক উন্নয়নশীল দেশের প্রাথমিক সমস্যা হচ্ছে বৈষম্য। আমি মনে করি এই বৈষম্য আমাদেরই সৃষ্টি। তাই আমরা নতুন সম্পদ সৃষ্টি এবং সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সেই সম্পদের ন্যায়ভিত্তিক সুষ্ঠু বন্টনের মাধ্যমে বৈষম্য কমিয়ে আনতে হবে। এসময় তিনি শহর গ্রামের চিন্তা থেকে সরে এসে সবার জন্য সমান সুযোগ সুবিধা দিয়ে সমন্বিত উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত বলে মন্তব্য করেন।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, ‘আমরা যখন জিডিপির উচ্চ প্রবৃদ্ধির দিকে যাচ্ছিলাম তখনই কোভিড-১৯ এবং পরে ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের আঘাত আসল।’ এখন দারিদ্র্য বিমোচনবান্ধব যত প্রকল্প রয়েছে সেগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন জরুরি এবং অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার বাস্তবায়নের একটি মধ্যমেয়াদী পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।